• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

আশ্রয়ণের ঘরটুকুই সেলিনার বেঁচে থাকার অবলম্বন

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২২ মার্চ ২০২৩  

‘জীবন কী, তা বোঝার আগেই হয়ে যায় বিয়ে। ছয় মাসের ব্যবধানে মা-বাবাকে হারাই। এরপর স্বামীও ছেড়ে যায়। ভাইদের সংসারে বোঝা হয়ে আসি। তারা আবার বিয়ে দেয়। কিন্তু তাতেও জোটেনি সুখ। কোলজুড়ে একটি মেয়ে সন্তান এলেও দ্বিতীয় স্বামীও খোঁজখবর নেন না। এখন মেয়েকে নিয়ে আশ্রয়ণের ঘরটুকু অবলম্বন করে বেঁচে আছি।’

সংসারের কঠিন বাস্তবতার এ গল্পটি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের দেওয়ানেরগাঁও গ্রামের সেলিনা আক্তারের। তিনি এক বছর আগে পেয়েছেন আশ্রয়ণের দুই শতক ভূমিসহ সেমিপাকা ঘর।

নিজ ঘরে আলাপকালে অকপটে নিজের জীবনের দুঃখগাঁথা তুলে ধরে সেলিনা আক্তার বলেন, দিনমজুর বাবা-মায়ের সংসারে আমরা তিন ভাই ও এক বোন ছিলাম। আদরের সন্তান হিসেবে বাবার নিজের পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন ১৭ বছর আগে। বিয়ের বছরই মা মারা যান। তার ছয়মাস বাদে বাবাকেও হারাই। মাস ছয় পর স্বামীও ছেড়ে দেয়। আমার জীবনের অবর্ণনীয় কষ্টের সময় ছিল তখন। স্বামীর ঘর হারিয়ে ভাইদের বাড়িতে এসে উঠি। তাদেরও সন্তান-সন্ততি নিয়ে টানাপোড়েনের সংসার। তার ওপর আমি বোঝা হয়ে আসি।

জীবন সংগ্রামী এ নারী বলেন, পরে ভাইয়েরা আবার আমাকে বিয়ে দেন। দ্বিতীয় স্বামীরও এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তিনিও আমাকে তেমন গুরুত্ব দেন না। শহরে নিজের বাড়িতে থাকেন। আমার ঠাঁই হয় ভাইদের সঙ্গে। কিন্তু কতদিন আমি তাদের বোঝা হয়ে থাকবো? এরপর প্রধানমন্ত্রী আমাকে দুই শতক জমিসহ সেমিপাকা ঘর উপহার দেন। এখানে আমি আমার মেয়েসহ থাকি। মানুষের বাড়ি কাজ করি। মেয়েটা এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। উপবৃত্তি পায়। বেশ ভালোভাবে এখন সংসার চলছে।

jagonews24

আগের চেয়ে ভালো আছেন কি না- এমন প্রশ্নে সেলিনা আক্তার বলেন, আগে তো ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। তারও পরিবার আছে। পাঁচ সন্তান। নানা সমস্যা হতো। আমার বলতে কিছু ছিল না। এখন ঘর আমার, বাড়ি আমার। আশপাশে ফাঁকা জায়গায় শাক-সবজি চাষ করেছি। হাঁস, মুরগি এবং ছাগল পালন করছি। অন্যের বাড়িতে কাজ করেও উপার্জন হয়। এক মেয়েকে নিয়ে দুজনের সংসার ভালোই চলে যায়। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।

তিনি বলেন, পর পর দুই স্বামীর ঘর হারিয়ে ভাইদের সঙ্গে থাকায় সমাজের মানুষেরা নানা কথা বলাবলি করতো। আমার খাওয়া-পরা নিয়ে অনেকে ভাইদের এটাওটা বলতো। ভাইয়েরা আমার জন্য মানুষের কটু কথাও শুনেছেন। এখন নিজের মনের সান্ত্বনা হিসেবে একটা ঘর তো আছে, এক টুকরো জায়গা তো আছে। নিজের মত বাঁচতে তো পারছি। চারপাশের লোকজন এখন কটু কথা বলতে পারে না। আমাকে নিয়ে ভাইদেরও আর দুশ্চিন্তা নেই।

বোনের এই লড়াকু জীবন নিয়ে এখন গর্ব হয় সেলিনার ভাই কফিল আহমেদের। তিনি বলেন, সমাজের নানা কথা এখন আর শোনা লাগে না। আমার বোন ভাগ্নিকে নিয়ে বেশ ভালো আছে। আমরাও মাঝেমধ্যে সাধ্যমতো সহায়তা করি। আশ্রয়ণের জমি ও ঘরের উছিলায় তার জীবনের কিছুটা গতি হয়েছে।

শুধু সেলিনা নয়, গোয়াইনঘাটের এমন হাজারো পরিবারের দুঃখ ঘোচাচ্ছে আশ্রয়ণের ঘর। হতদরিদ্র ও সংকটাপন্ন মানুষদের জুগিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। নতুর স্বপ্ন ও জীবন গড়ার পথ বাতলে দিয়েছে। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে সিলেটের গোয়াইঘাট উপজেলার কয়েকটি আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে সেলিনা আক্তারের মতো এমন আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনা গেছে।

jagonews24

গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, গোয়াইনঘাটে আশ্রয়ণের এগারশো ঘর নির্মাণ করেছি। ৮৯৫টি ঘর হস্তান্তর হয়েছে। ১২৪টি বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মাণাধীন রয়েছে। খুব দ্রুত এগুলোও হস্তান্তর করা হবে।

তিনি বলেন, যারা এক বা দুই বছর আগে ঘর পেয়েছেন, তাদের জীবনমানে বেশ ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। আশা করি, দারিদ্র্য দূরীকরণ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে এটি মাইলফলক হবে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস রানা বলেন, আশ্রয়ণের এসব ঘর কিন্তু মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য। এটি সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া। আজকে ভূমিহীন-গৃহহীন, হতদরিদ্র বা অসহায় মানুষদের এসব ঘরের মাধ্যমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে। নতুন করে তাদের জমি কিনে ঘর করার চিন্তা করতে হচ্ছে না। এর ফলে তাদের অনেকে সন্তানদের একটু ভালো পড়াশোনার দিকে নজর দিতে পারছেন। যে সন্তানরা একদিন এসব পরিবারকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে পারবেন।

তিনি বলেন, আজকে তারা সেমিপাকা ঘরে আছেন, সন্তানরা ভবিষ্যতে এর চেয়ে ভালো কিছু করবে। প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এটিই চান। আশ্রয়ণের মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোতে তুলে আনতে চান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে দেশে প্রথম ভূমিহীনদের পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করেন। বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চরপোড়াগাছা গ্রামে একই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প শুরু করেন।

jagonews24

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে পুনরায় জমি ও ঘরের মালিকানা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেন।

এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট সাত লাখ ৭১ হাজার ৩০১টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। পরিবারপ্রতি ৫ জন হিসেবে এ কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫০৫ জন।

এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প সরাসরি পুনর্বাসন করেছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৫৯৭টি পরিবারকে। ভূমি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের সমান কার্যক্রমের আওতায় পুনর্বাসিত হয়েছে আরও দুই লাখ ১৬ হাজার ৭০৪টি পরিবার।

মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিটি গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে বিনামূল্যে পরিবারভিত্তিক স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দুই শতাংশ জমির মালিকানার দলিল ও নামজারি সম্পাদন করে দেওয়া হয়। এই জমিতে সম্পূর্ণ সরকারি খরচে দুটি কক্ষ, প্রশস্ত বারান্দা, একটি স্যানিটারি টয়লেট ও একটি রান্নাঘর সম্বলিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব ডিজাইনের একটি অনন্য সাধারণ ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়।