• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

নেতাকর্মীদের দুই কৌশলে এগোনোর নির্দেশনা আ.লীগের

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ১ জুন ২০২৩  

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটের আমেজ তৈরির চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে বিরোধীদের সঙ্গে যেকোনও ধরনের সংঘাত এড়িয়ে চলতে নেতাকর্মীদের সতর্কবার্তা দিয়েছে দলটি। রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে নির্বাচন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সমন্বিত কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। বলা হয়েছে, বিরোধীদের কর্মসূচি দেখে দলের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে, যাতে নেতাকর্মীদের যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে থাকার বার্তা দেওয়া যায়।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিকে কেন্দ্র করে বিএনপি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির নামে তারা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, যাতে এই সংঘাতের দায় ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপানো যায়। তাতে পশ্চিমাদের চাপ আরও বাড়বে। ফলে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতে না জড়াতে বলা হয়েছে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাদের। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে বেশ সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।

নেতারা জানান, ভোটের আমেজ তৈরির জন্য সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করতে বলা হয়েছে দলের সব পর্যায়ের নেতাদের। এ ব্যাপারে গাজীপুরের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভালো নির্বাচন চাইলেও বিএনপি তা বানচাল করতে চায় এবং সে জন্য ভিসানীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ একা নয়, বিএনপিও বিপাকে রয়েছে— সেটি প্রচারের তাগিদ এসেছে। এভাবে নির্বাচনের পক্ষে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে জনমত গঠনের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধ থেকে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দলীয় সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ রয়েছে, এটা ঠিক। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সঙ্গে সেই চাপ মোকাবিলার কৌশলও নির্ধারণ করছে আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে গাজীপুর, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা ও সিলেট সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিএনপিবিহীন এসব নির্বাচনে ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভোটের আমেজ তৈরি করতে তৎপরতা চলবে। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের বার্তা দেওয়া হবে যে, বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব এবং আগামী নির্বাচনও এভাবে নিরপেক্ষ করবে সরকার। এখন বিএনপি তাতে অংশ নিলেই সেটি অংশগ্রহণমূলক হবে— সেজন্য দলটিকে পশ্চিমারা চাপ দিক।

সূত্রমতে, গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ সিটিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলায় ভোটের আমেজ তৈরি হয়েছে। ফলে ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি বড় ধরনের আন্দোলনে যেতে পারছে না। দলটির কর্মসূচিতেও সেটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সে জন্য বিরোধীরা আন্দোলনের আবহ তৈরি করতে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে পারে। বিএনপি পশ্চিমাদের দেখানোর চেষ্টা করবে– তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সতর্ক করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, বিএনপির কর্মসূচির বিপরীত কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকতে হবে। তবে সংঘাত এড়িয়ে চলতে হবে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘পাঁচ সিটিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে কেন্দ্রীয় টিম গঠন করে কাজ করছি। এর মধ্যে গাজীপুরে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে আমরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। এখন মানুষ নির্বাচনি মুডে রয়েছে। আমরা চাই, বিএনপি সিটি নির্বাচন বর্জন করলেও জাতীয় নির্বাচনে আসুক। আমরা কোনও ধরনের সংঘাত চাই না।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুই সদস্য এবং সম্পাদকমণ্ডলীর তিন সদস্য বলেন, মার্কিন ভিসানীতি আসার পরে ধীরে চলার নীতি নেওয়া হলেও বক্তৃতা-বিবৃতিতে আক্রমণাত্মক অবস্থানে থাকার কৌশল নেওয়া হয়েছে। রাজপথে নিয়মিত কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে। পশ্চিমাদের কাছে বিএনপির নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা ছাড়াও সরকারের ইতিবাচক অবস্থান জানিয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়ানো এবং বিএনপিকে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে আনতে কূটনীতিক চাপ বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে আওয়ামী লীগ, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আগ বাড়িয়ে অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান বলেন, ‘মার্কিন ভিসানীতি বিএনপির জন্যও বুমেরাং হয়েছে। তারা নির্বাচন বাধা দিতে আসলে বা সহিংসতা করলে সমস্যায় পড়তে হবে। আমরা অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করবো, তাতে বিএনপিকেও আসতে হবে। আওয়ামী লীগ সহিংসতা এড়িয়ে চলবে।’

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকায় তারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। এখন মার্কিন ভিসানীতির ওপর ভর করে আন্দোলন করার চেষ্টা করছে বিএনপি। আমরা তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবো, আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তারা যাতে সহিংসতা করতে না পারে, সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি। তারা যাতে অঘটন ঘটিয়ে তার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপাতে না পারে, সে ব্যাপারেও নেতাকর্মীদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

গত ২৩ মে (মঙ্গলবার) বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে নেতাকর্মীদের সতর্ক করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। তারা (বিএনপি) নির্বাচন চায় না। তারা চায় সংঘাত, অস্থিরতা, অশান্তি ও রক্তপাত। আমরা কারও সঙ্গে পাল্টাপাল্টি সংঘাতে যাবো না। কথায় কথায় আপনারা মাথা গরম করবেন না।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাতার সফরে যাওয়ার আগে ‘কোনও সংঘাতে যাওয়া যাবে না’ মর্মে নির্দেশনা দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সংঘাতে যাবো না, কিন্তু সংঘাত কেউ করতে এলে আমরা চুপ করে বসে থাকবো? আমাদের ওপর যদি কেউ হামলা চালায়, তাহলে আমরা হামলা চালাবো না? হামলা করলে তার সমুচিত জবাব কীভাবে দিতে হয়, তা আওয়ামী লীগ জানে।’

কিন্তু ২৬ মে (শুক্রবার) ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জ ও খাগড়াছড়িতে কর্মসূচিতে হামলা-পাল্টা হামলা নিয়ে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ করে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। পরদিন বাড্ডায় এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘কেরানীগঞ্জে নাটক, খাগড়াছড়িতেও নাটক। কেরানীগঞ্জে বিএনপির নাটক ধরা খেয়েছে। আওয়ামী লীগকে আক্রমণকারী সাজাতে এই নাটক বানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি প্রকাশ করেছে, তাতে নির্বাচনে বাধা দিলে খবর আছে। সে জন্য বিএনপি নতুন কৌশল নিয়েছে।’

সবশেষ ২৮ মে (রবিবার) বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যৌথসভা হয়। সেখানে দলটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের ক্ষেত্র আমরা প্রস্তুত করছি এবং প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। নির্বাচনে যারা বাধা দেবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগ করবে। বিএনপি ঘোষণা করে বাধা দিচ্ছে।’

কেরানীগঞ্জ ও খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের অফিস আক্রমণ এবং নেতাকর্মীদের আহত করার অভিযোগ করে তিনি বলেন, নাটক সাজিয়ে ইচ্ছে করে বিএনপি গোলমাল সৃষ্টি করলো। তাদের এটাই লক্ষ্য, অথচ তারা বোঝাতে চায় যে আওয়ামী লীগ বাধা দিচ্ছে। সেজন্য আমাদের নেতাকর্মীদের বলি, আমাদের শান্তি সমাবেশ নির্বাচন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকুক। কেরানীগঞ্জের ঘটনায় আক্রমণকারী তারা। অথচ তারা বিদেশিদের কাছে প্রচার করেছে যে আক্রমণকারী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। কাজেই কোনও অবস্থাতেই মাথা গরম করবেন না।

দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে সব জেলা, মহানগর, ইউনিয়ন, প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনও অবস্থাতেই আক্রমণকারী হবেন না। কারণ, বিএনপি এখন যে কোনোভাবে দেখাতে চায় যে আমরা আক্রমণকারী। গাজীপুরে আমরা কিছু ভোটে হেরে গেছি। কিন্তু নির্বাচন গণতান্ত্রিক, অবাধ হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে কেউ কিছু বলতে পারেনি। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে জয়ী করেছি সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন করে। সামনেও বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীতে ইলেকশন আছে। এই নির্বাচনগুলোও অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। শেখ হাসিনা সরকারের নীতি হচ্ছে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন করতে হবে।

সমন্বিত কর্মসূচি পালনের নির্দেশ

সহযোগী সংগঠনগুলোকে পৃথক কর্মসূচি পালন না করে আওয়ামী লীগের সমাবেশে অংশ নিতে বলা হয়েছে। এতে বিরোধীদের সঙ্গে সংঘাতের ঝুঁকি এড়ানোর পাশাপাশি নিজেদের শক্তি প্রদর্শনও ত্বরান্বিত হবে। ২৮ মে (রবিবার) ঢাকা মহানগর ও সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যৌথসভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এখন সবার ইউনাইটেডলি মুভ করতে হবে, কোনও ছাড় নেই। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে সহযোগীসহ অন্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের অংশ নিতে হবে।

আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিজেরা নিজেদের সঙ্গে লড়াই করলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চায়ের দোকানে বসে নিজের দলের লোকের নামে গিবত করবেন, এটা আওয়ামী লীগ নয়। আওয়ামী লীগের কোনও নেতাকর্মী তা করতে পারে না। যারা প্রার্থী আছেন, একসঙ্গে জনসংযোগ করে নৌকার পক্ষে ভোট চাইবেন। আমাদের নেত্রী ও মনোনয়ন বোর্ড যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে কাজ করবেন। আমরা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী রাখবো, নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকবো।