• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১০ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

অতীতের মহামারিগুলো যেভাবে দূর হয়েছিল

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৮ মার্চ ২০২০  

 

বিশ্বজুড়ে মহামারী রুপ নিয়েছে করোনা ভাইরাস। দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার সাতশ ২৩ জনে। তার মধ্যে ২৭ হাজার তিনশ ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য আক্রান্তের পর সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ৩৩ হাজার তিনশ ৫৫ জন।

তবে এটাই প্রথম নয় এর আগেও বিশ্বে দেখা দিয়েছিল মহামারি রোগ। মহামারির ইতিহাস অনেক পুরোনো। যখন থেকে ঘটনা লিপিবদ্ধ করা বা ইতিহাস রচনার শুরু, সেই সময় থেকেই মহামারির অস্তিত্ব জানা যায়। মানবসভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, সংক্রামক রোগ তত ভয়ংকর হয়েছে। 

গত কয়েক হাজার বছরে অসংখ্য মহামারি এই পৃথিবীতে এসেছে। ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ক্ষান্তও হয়েছে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক, অতীতের কিছু ভয়ংকর মহামারির ধরণির বুক থেকে দূর হওয়ার কাহিনি।

জাস্টিনিয়ান প্লেগ

৫৪১ সালে এই রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুরুটা হয়েছিল মিসর থেকে। এরপর বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও সেখান থেকে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই প্লেগ। ৫৪১ সালে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনপোলে এই মহামারি পৌঁছায়। সম্রাট জাস্টিনিয়ান ওই সময় রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাইজেন্টাইনকে একীভূত করার পরিকল্পনা করছিলেন। মহামারির তাণ্ডবে তা আর হয়নি। এই সম্রাটের নাম থেকেই মহামারির নামকরণ হয়েছিল। কনস্টানটিনপোল থেকে এই রোগ ইউরোপ, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও আরব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই প্লেগের মূল বাহক ছিল ইঁদুর। বলা হয়ে থাকে, ভয়ংকর এই মহামারিতে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অনেকে আবার বলেন, এতে নাকি বিশ্বের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

কিন্তু এই মহামারি কীভাবে ‘নাই’ হলো? যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর দেপল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক থমাস মকাইটিস বলছেন, মানুষ তখন বুঝতে পারেনি যে কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ করবে। তাই একপর্যায়ে অসুস্থ লোকদের এড়িয়ে যাওয়া শুরু করে সুস্থরা। যতটুকু জানা যায়, একপর্যায়ে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে। যারা বেঁচে ছিল, তাদের মধ্যে ওই রোগের প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়েছিল।

ব্ল্যাক ডেথ

পৃথিবীর মানুষকে প্লেগ ভুগিয়েছে অনেক। জাস্টিনিয়ান প্লেগের ৮০০ বছর পর আবার আসে প্লেগের মহামারি। ১৩৪৭ সালে এটি ইউরোপে আঘাত হানে। পরবর্তী চার বছরে প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয় এই মহামারিতে। এটি ছিল একধরনের বুবোনিক প্লেগ। নাম পেয়েছিল দ্য ব্ল্যাক ডেথ। এ ক্ষেত্রেও রোগের বৈজ্ঞানিক কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না মানুষ। তবে বুঝতে পেরেছিল যে জনঘনত্ব বেশি হলে রোগ ছড়ায় বেশি। এই মহামারির সময়েই প্রথমবারের মতো নাবিকদের আলাদাভাবে রাখার চল শুরু হয়েছিল। তারা সুস্থ—এটি নিশ্চিত হওয়ার পরই ছাড়া হতো।

ব্ল্যাক ডেথের দিনগুলোতেই কোয়ারেন্টিনের ধারণার উদ্ভব হয়েছিল। রোগ নিয়ন্ত্রণে একপর্যায়ে জাহাজের নাবিকদের ৪০ দিনের কোয়ারেন্টিনে রাখার নিয়ম শুরু হয়েছিল ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর রাগুসাতে। পরে এই নিয়ম পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনের নিয়ম চালু হওয়ার বিষয়টি মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। 

কলেরা

প্লেগের মতোই কলেরাও মানুষকে ভুগিয়েছে অনেক। কলেরা রোগের প্রথম মহামারির শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ায়, ১৮১৭ সালে। সেখানে এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি, ভারত ও আমেরিকাতেও কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল মহামারি আকারে। ওই সময় সব মিলিয়ে ২২–২৩ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। পরবর্তী আরও দেড় শ বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় মহামারি আকারে দেখা দিয়েছিল।

দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন

ব্ল্যাক ডেথের পরও স্বস্তি মেলেনি লন্ডনের। পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ধরে নির্দিষ্ট সময় পর পর প্লেগের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ইংল্যান্ড। ১৬৬৫ সালে সবচেয়ে মারাত্মক বুবোনিক প্লেগ মহামারি আকারে লন্ডনে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাত্র সাত মাসে লন্ডনের প্রায় ১ লাখ অধিবাসীর মৃত্যু হয়েছিল। এই সময়টায় আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন প্রভৃতিতে অভ্যস্ততা তৈরি হয়। শুরু হয়েছিল আক্রান্তদের চিহ্নিত করার কাজ। এমনকি আক্রান্তের পরিবারের সদস্য হলেও পৃথক চিহ্ন বহন করতে হতো। রোগের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সম্পূর্ণ ‘লকডাউন’ বা সর্বস্তরের জনসাধারণকে ঘরে থাকার চল শুরু হয়েছিল লন্ডনে। প্রাথমিকভাবে রোগের উৎস হিসেবে কুকুর-বিড়ালের কথা ভাবা হয়েছিল। রোগের আতঙ্কে তখন নির্বিচার শহরের কুকুর-বিড়াল মেরে ফেলা হয়েছিল। লন্ডনের পুরো জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল গ্রেট প্লেগের দিনগুলোয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একপর্যায়ে রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে সব অসুস্থ লোকের বাড়িতে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। মৃতদের লাশ জোর করে গণকবরে দাফন করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, এসব পদক্ষেপেই একসময় এই ভয়ংকর প্লেগ পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে দূর হয়েছিল।

গুটিবসন্ত

ইউরোপ, এশিয়া ও আরব অঞ্চলে গুটিবসন্ত অনেক আগে থেকেই প্রাণঘাতী ছিল। তবে তা ছিল কিছুটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। এসব অঞ্চলে অনেকের শরীরে ওই রোগের প্রতিরোধক্ষমতা জন্মেছিল। কিন্তু নতুন উপনিবেশগুলোর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে গুটিবসন্ত ছিল একেবারেই নতুন রোগ। ফলে ১৫ শতকে সেখানে যখন ইউরোপীয়রা যাওয়া শুরু করে, তারা একই সঙ্গে রোগের জীবাণুও পৌঁছে দিতে থাকে। বিশেষ করে মেক্সিকো ও আমেরিকায় গুটিবসন্ত চূড়ান্ত আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। কারণ, এই অঞ্চলের আদিবাসীদের শরীরে গুটিবসন্তের কোনো প্রাকৃতিক প্রতিরোধক্ষমতা ছিল না।

গুটিবসন্তই প্রথম মহামারি, একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যার ইতি ঘটেছিল। গুটিবসন্ত মহামারি হিসেবে দেখা দেওয়ার প্রায় শতাব্দীকাল পর এডওয়ার্ড জেনার নামের একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক গুটিবসন্তের টিকা তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন। তাঁর দেখানো পথ ধরেই গুটিবসন্তের কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছিল।

তবে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা খুব দীর্ঘ ছিল। অবশেষে ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীকে গুটিবসন্তমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করে।জন স্নো নামের এক ব্রিটিশ চিকিৎসক প্রথম কলেরা রোগের বিস্তারের সঙ্গে দূষিত পানির যোগসূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। গবেষণা করে তিনি দেখিয়েছিলেন, যেসব এলাকায় কলেরায় মৃত্যুর হার বেশি, সেখানে পানি দূষিত ছিল। পরে জন স্নোর নিরলস চেষ্টাতেই লন্ডনের পানির পাম্পগুলোর হাতল সরিয়ে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এবং ম্যাজিকের মতোই এর পর থেকেই কলেরার সংক্রমণ ওই অঞ্চলে কমে আসতে থাকে। এ ঘটনার পরই বিশ্বের নগরগুলোর স্যানিটেশন ব্যবস্থা উন্নত করার বিষয়টি কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকার তালিকায় সর্বাগ্রে স্থান পেতে থাকে। সেই সঙ্গে পানীয় জলের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। আর জন স্নোকে এখন আধুনিক রোগতত্ত্বের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়।

অবশ্য উন্নত দেশগুলোতে কলেরা পুরোপুরি নির্মূল করা গেলেও, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা এখনো আছে। কারণ, সেসব দেশে পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব রয়েছে।

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স, ইনসাইডার ডট কম, হিস্ট্রি ডট কম, দ্য ব্যালান্স ডট কম ও কোয়ার্টজ