• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

ইসলামের দৃষ্টিতে অপচয় ও অপব্যয়

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০২০  

জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করা এবং সম্পদ ভোগ করার অনুমতি ও নির্দেশ প্রত্যেক ধর্ম ও সভ্যতায় রয়েছে। কিন্তু অন্য কোনো ধর্ম বা সভ্যতায় ইসলামের মতো আয়-ব্যয়কে নিয়ম-নীতির ফ্রেমে আবদ্ধ করা হয়নি।

ইসলাম একদিকে যেমন হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের নির্দেশ দিয়েছে, অপরদিকে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ বৈধ পথে ব্যয় করারও নির্দেশ দিয়েছে।

মানব সমাজে অর্থ ও সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় আজ একটি বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম এটিকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

ইসরাফ ও তাবযীর এর অর্থ :

আরবি ‘ইসরাফ’ (إسراف) শব্দের অর্থ হলো সীমালঙ্ঘন, অপচয়, অপব্যয়, অমিতব্যয়, বাড়াবাড়ি, মাত্রাতিরিক্ততা, অপরিমিতি। (ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান (ঢাকা : রিয়াদ প্রকাশনী, ৫ম সংস্করণ, ২০০৮, পৃঃ ৭৮)

কতিপয় বিদ্বান ‘ইসরাফ’ শব্দকে ব্যয় করা ও খাওয়ার সঙ্গে নির্দিষ্ট করেছেন। বিশিষ্ট ভাষাতত্ত্ববিদ শরীফ আলী জুরজানী (৭৪০-৮১৬ হিঃ) ‘ইসরাফ’ এর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে,

الإسراف هو إنفاق المال الكثير في الغرض الخسيس وتجاوز الحد في النفقة، وقيل: أن يأكل الرجل ما لا يحل له، أو يأكل مما يحل له فوق الاعتدال، ومقدار الحاجة-

‘ইসরাফ হলো কোনো হীন উদ্দেশ্যে প্রচুর অর্থ-সম্পদ ব্যয় করা এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা। কেউ কেউ বলেন, কোনো ব্যক্তির অবৈধ বস্ত্ত ভক্ষণ করা অথবা তার জন্য যা কিছু হালাল তা অপরিমিত ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার করা’।  (শরীফ আলী জুরজানী, কিতাবুত তা‘রীফাত (বৈরূত: দারুল কিতাবিল আরাবী, ১৪০৫ হি.), পৃঃ ৩৮)

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

كُلُوا مِنْ ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَآتُوا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

‘তোমরা এগুলোর ফল খাও যখন তা ফলবন্ত হয় এবং এগুলোর হক আদায় কর ফসল কাটার দিন। আর তোমরা অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’। (সূরা : আন‘আম ৬/১৪১)

ইবনু আববাস (রা.) বলেন,من أنفق درهما في غير حقه فهو سرف ‘যে ব্যক্তি অনর্থক কাজে এক দিরহামও খরচ করল সেটাই অপচয়’। (ইমাম কুরতুবী, আল-জামি‘ লি আহকামিল কোরআন (বৈরূত : দারু ইহয়াইত তুরাছিল আরাবী, ১৯৮৫ খ্রি./১৪০৫ হি.), ১৩তম খন্ড, পৃঃ ৭৩)

আর ‘তাবযীর’ (التبذير) অর্থও অপচয়, অপব্যয়, বাজে খরচ, অমিতব্যয় ইত্যাদি। (আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান, পৃঃ ২০২) 
এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো القاء البذر وطرحه অর্থাৎ বীজ ছিটানো ও নিক্ষেপ করা। এ থেকে শব্দটি রূপকভাবে অর্থ-সম্পদ অযথা ব্যয় করার অর্থে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (রাগিব ইস্পাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃঃ ৪০)

আল্লাহ তায়ালা বলেন,وَلَا تُبَذِّرْ تَبْذِيرًا، إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ وَكَانَ الشَّيْطَانُ، ‘তুমি অপব্যয় করবে না, নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই’। (সূরা: বনী ইসরাঈল ১৭/২৬-২৭)

ফক্বীহগণ ‘তাবযীর’-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে যে, عدم إحسان التصرف في المال وصرفه فيما لا ينبغي، ‘সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না করা এবং তা অনুচিত কাজে ব্যয় করা’। (ইমাম নববী, তাহরীরু আলফাযিত তানবীহ (দামেশক : দারুল কলম, ১৪০৮ হি.), পৃঃ ২০০)

অপচয় ও অপব্যয়ের কারণ :

অপচয় ও অপব্যয়ের বহু কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি মৌলিক কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

১. দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা : ইসলাম মানুষকে বিভিন্নভাবে অপচয় ও অপব্যয় করতে নিষেধ করেছে। অজ্ঞতার বশবর্তী হয়েই মূলত মানুষ অপচয় করে থাকে। কোনো ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানে পারদর্শী হলে তার দ্বারা অপচয় করা সম্ভব হতো না। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا بَنِي آدَمَ خُذُوا زِينَتَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْرِفِينَ

‘হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পোষাক পরিধান কর। তোমরা খাও ও পান কর। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালবাসেন না’। (সূরা : আ‘রাফ ৭/৩১)।

অপচয়কারীকে দুনিয়াতে আফসোস ও লজ্জিত হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَى عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا 

‘আর তুমি তোমার হাত গলায় বেড়ী করে রেখ না (অর্থাৎ কৃপণ হয়ো না) এবং তাকে একেবারে খুলেও দিয়ো না (অর্থাৎ অপচয় করো না)। তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হয়ে যাবে’। (সূরা : বনী ইসরাঈল ১৭/২৯)

অপচয়কারীর জন্য আখেরাতে রয়েছে কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আল্লাহ বলেন,

وَأَصْحَابُ الشِّمَالِ مَا أَصْحَابُ الشِّمَالِ، فِي سَمُومٍ وَحَمِيمٍ، وَظِلٍّ مِنْ يَحْمُومٍ لَا بَارِدٍ وَلَا كَرِيمٍ، إِنَّهُمْ كَانُوا قَبْلَ ذَلِكَ مُتْرَفِين 

‘আর বাম পাশের দল। কতই না হতভাগ্য তারা! তারা থাকবে উত্তপ্ত বায়ু ও ফুটন্ত পানির মধ্যে। যা শীতল নয় বা আরামদায়ক নয়। ইতোপূর্বে তারা ছিল ভোগ-বিলাসে মত্ত’। (সূরা : ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৪১-৪৫)

অপচয়কারীর দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলাফল হলো, বৈধ জিনিস গ্রহণ করতে সে সীমালঙ্ঘন করে। আর এটাই তাকে শারীরিক ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এ কারণেই অলসতা তার ওপর চেপে বসে। ওমর (রা.) বলেন,

إياكم والبطنة في الطعام والشراب فإنها مفسدة للجسد مورثة للفشل مكسلة عن الصلاة وعليكم بالقصد فيهما فإنه أصلح للجسد وأبعد من السرف 

‘তোমরা সীমাতিরিক্ত পানাহার থেকে সাবধান থাক। কেননা অতিরিক্ত পানাহার শরীরের জন্য ক্ষতিকর, অকর্মন্যতা আনয়নকারী ও সালাত থেকে অলসকারী। তোমরা পানাহারের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। কেননা পরিমিত পানাহার শরীরের জন্য উপকারী এবং অপচয় থেকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে’।  (ইবনু মুফলিহ আল-মাক্বদিসী, আল-আদাবুশ শারইয়্যাহ (রিয়াদ : মাকতাবাতুর রিয়াদ আল-হাদীছাহ, ১৩৯১ হি.), ২য় খন্ড, পৃঃ ২০১)

২. পারিবারিক প্রভাব : মানুষ শিশুকালে তার পিতা-মাতার আচরণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা যদি অপচয়কারী হয় তাহলে সন্তানও অপচয়ের শিক্ষা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে অভিভাবকবৃন্দকে সচেতন হতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন,

كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ 
‘প্রত্যেক নবজাতক ফিৎরাতের ওপর তথা ইসলামের ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহূদি বা নাছারা অথবা অগ্নি পূজক বানায়’। (বুখারি হা/১৩৮৫; সহিহুল জামে‘ হা/৪৫৫৯)

৩. অপচয়কারীদের সাহচর্য : অপচয়ের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো অপচয়কারীদের সঙ্গ ও সাহচর্য। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তার সঙ্গীর চরিত্র গ্রহণ করে থাকে। তাই সঙ্গী অপচয়কারী হলে তার অন্যান্য সঙ্গীরাও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

الرَّجُلُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ 

‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার সঙ্গীর দ্বীন গ্রহণ করে। সুতরাং তোমরা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করবে’। (আবুদাঊদ হা/৪৮৩৩, ‘আদাব’ অধ্যায়)

৪. পরিচিতি ও খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা : অপচয়ের আরেকটি কারণ হলো সমাজে নিজের খ্যাতির আকাঙ্ক্ষা করা। মানুষ অন্যের সামনে নিজের বড়ত্ব প্রকাশের জন্য তার সম্পদ অকাতরে খরচ করতে থাকে। মূলতঃ এর মাধ্যমে সে অপচয়ে জড়িয়ে পড়ে, যা সম্পূর্ণ হারাম।

৫. বাস্তব জীবনের প্রয়োজন সম্পর্কে উদাসীনতা : অধিকাংশ মানুষ অর্থ-সম্পদ হাতে আসলেই বেহিসাব খরচ করে। সে একটিবারও ভেবে দেখে না যে, দুনিয়ার জীবন সর্বাবস্থায় সমান্তরাল গতিতে চলে না। আজকে হাতে অর্থ আছে কালকে নাও থাকতে পারে। তাই প্রত্যেকের উচিত, আল্লাহর দেয়া প্রতিটি নেয়ামত যথাযথভাবে ব্যয় করা। আজকের অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় নির্বাহ করে বাকী অর্থ-সম্পদ ভবিষ্যতের জন্য জমা করে রাখা উচিত। যা তার বিপদের সময় কাজে আসতে পারে।

৬. কেয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা সম্পর্কে উদাসীনতা : অপব্যয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে কেয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা ও শাস্তি সম্পর্কে উদাসীনতা। যেকোনো ব্যক্তি পরকালের কঠিন পরিণতির কথা চিন্তা করলে সে অবশ্যই অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকবে।