• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

ইসলামের মুদ্রাব্যবস্থা স্বর্ণ-রৌপ্যনির্ভর

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৬ জানুয়ারি ২০২০  

 

আল্লামা ইবনু খালদুন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা স্বর্ণ-রৌপ্যের মতো দুটি মূল্যবান খনিজ সম্পদ তৈরি করেছেন প্রত্যেক জিনিসের মূল্যমান নির্ধারক হিসেবে।’ [মুকাদ্দামাতু ইবনি খালদুন]

ইমাম ইবনু তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্বর্ণ-রৌপ্য তথা মুদ্রার মূল উদ্দেশ্যই হলো এটা সমস্ত পণ্যমূল্যের মাপকাঠি হবে। এর মাধ্যমে সকল সম্পদের মূল্য জানা যাবে।’ [মাজমুয়ুল ফাতাওয়া]

ইবনুল কাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্বর্ণ-রৌপ্য হলো সকল জিনিসের মূল্য। আর মূল্য এমন মাপকাঠি হওয়া চাই যার মাধ্যমে সম্পদের মূল্যমান পরিমাপ করা হবে। ফলে তা অবশ্যই নির্দিষ্ট এবং স্থিতিশীল হতে হবে। যার মূল্যমান কখনো বাড়বেও না কমবেও না। কারণ যদি অন্যান্য পণ্যের মতো মূল্যমান মাপকাঠিতেও হ্রাস-বৃদ্ধি আসে তাহলে এমন আর কোনো মাপকাঠি নেই যার মাধ্যমে আমরা পণ্যসমূহের মূল্যমান বের করতে পারি। তখন সবকিছুই পণ্য হয়ে যায়। অথচ মানব সমাজের জন্য আবশ্যকীয় এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয় হলো এই মূল্যমান নির্ধারণ মাপকাঠি।’ [ইলামুল মুওয়াক্কিয়িন]

উলামাদের এ রকম আরও অনেক বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে, যেগুলোর মাধ্যমে প্রকৃত মুদ্রাব্যবস্থার স্বরূপ জানা যায়। জানা যায়, স্বর্ণ-রূপার খোদায়ী সৃষ্টিগত উদ্দেশ্য। আর উল্লেখিত বক্তব্যগুলো তুলে ধরার কারণও এগুলোর সৃষ্টিগত অবস্থান এবং উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা। এর মাধ্যমে সহজেই প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার আধ্যাত্মিক অসারতা বুঝা যাবে।

বিশ্বের বর্তমান কারেন্সি সিস্টেম পেপারকে অতিক্রম করে ইলেক্ট্রনিক কারেন্সিতে বিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় হয়তো অলরেডি হয়েই গেছে। আর এটাই অর্থনৈতিক দাসত্বের চূড়ান্ত স্টেপ হতে পারে। কারেন্সি সিস্টেম থেকে দিনার-দিরহাম কীভাবে বিদায় নিল, এর পিছনে কাদের ষড়যন্ত্র ছিল এবং কী উদ্দেশ্য ছিল সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা হবে না। সাথে সাথে পেপার কারেন্সি সিস্টেম কীভাবে একপক্ষকে জিম্মি করে অপর পক্ষগুলোকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, প্রচলিত কারেন্সি সিস্টেমের সাথে সুদের ওতপ্রোত সম্পর্ক এবং সমস্ত দিনার-দিরহামকে একপক্ষের কাছে কুক্ষিগত করে রাখা, আবার কেনই বা পেপার কারেন্সি সিস্টেম আমাদের অর্থনৈতিক দেওলিয়াত্বে ফেলতে পারে এই প্রশ্নগুলোর টেকনিক্যাল রিজনগুলোও এখানে আলোচনায় আসবে না। যদিও আমাদের পূর্ববর্তী কিছু বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বহু আগেই এগুলোর টেকনিক্যাল রিজন নিয়েও মৌলিক ধারণা দিয়ে গেছেন। আমি শুধু এখানে আমাদের অর্থনৈতিক দাসত্ব ও দেউলিয়াত্বের আধ্যাত্মিক একটি কারণ দেখাব।

আল্লামা গাজালি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যে ব্যাক্তি কোন জিনিসকে তার সৃষ্টিগত অবস্থা কিংবা উদ্দেশ্য ভিন্ন কোনো উপায়ে ব্যবহার করল, সে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করল।’ এরপর তিনি উদাহরণ হিসেবে দিনার-দিরহামকে উল্লেখ করে বলেন, ‘মহান আল্লাহ তায়ালা এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন সকল জিনিসের মূল্যমান নির্ধারক হিসেবে। এখন এগুলোকে ভিন্ন কোনো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, কুক্ষিগত করে রাখা নিশ্চিয় জুলুম এবং আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা। [ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, কিতাবুস সবর ওয়াশ শুকর]’

আর প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থা সেই কাজটাই করে আসছে। দিনার-দিরহামকে তার সৃষ্টিগত অবস্থান থেকে সড়িয়ে কাগজ আর ইলেক্ট্রনিক ভিজিটকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছে। এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা হচ্ছে। আর আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করা খুবই ভয়াবহ বিষয়। ‘কুফরু নিয়ামিল্লাহ’ এর দরুণ আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই বান্দাদের ওপর নানা ধরনের শাস্তি চাপিয়ে দিতে পারেন। তিনি বলেন, ‘যদি তোমরা আমার নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করো (তার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে), তাহলে আমি সেই নেয়ামত আরও বাড়িয়ে দেব। আর যদি সেই নেয়ামতকে অস্বীকার করো, তবে জেনে রাখো! আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।’ [সুরা ইবরাহিম : ৭]

সুতরাং আমরা পেপার কারেন্সি সিস্টেমের আওতায় নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর নেয়ামতের নাশুকরিয়া করছি। ‘কুফরু নিয়ামিল্লাহ’ এর নানান সুরত হতে পারে। তাঁর নেয়ামতের অস্বীকৃতির জন্য আযাবের ধরনও বিভিন্ন রকম হতে পারে। তিনি সংশ্লিষ্ট নেয়ামতকে উঠিয়ে নিতে পারেন আবার অন্য কোনো বিপদেও ফেলতে পারেন।

কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পেপার কারেন্সি সিস্টেমের মাধ্যমে আমরা যেই নেয়ামতের অস্বীকৃতি প্রকাশ করছি, সেটা জাতির অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। ফলে এখানে শাস্তিটা অর্থনৈতিক ক্রাইসিস সৃষ্টির মাধ্যমেই হতে পারে। আমাদের বাংলাদেশসহ বর্তমান বিশ্বে যেই অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চলছে এর পিছনে অন্যান্য কিছু কারণের উপস্থিতির পাশাপাশি সবচেয়ে ভয়াবহ, গুরুতর এবং অন্যতম কারণ হলো প্রচলিত কারেন্সি সিস্টেম। একজন মুসলিম হিসেবে কেবল উল্লেখিত আধ্যাত্মিক কারণ থেকেই আমি এমনটা বিশ্বাস করতে পারি। এটা বিশ্বাস করতে এর চেয়ে বেশি গবেষণারও প্রয়োজন নেই। আর যদি আমরা টেকনিক্যাল রিজনগুলোও সামনে রাখি তবে আরও নিশ্চিতভাবে বিষয়টি আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে।

লেখাটা পড়ার পর স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তাহলে কী করতে পারি। এ এক জটিল প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের উত্তরে আপাত করণীয় বিভিন্ন কঠিন কঠিন বিষয় আসতে পারে। তবে এর সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো উম্মাহকে সতর্ক করার পাশাপাশি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। কারণ একটি স্বাধীন ইসলামি রাষ্ট্র ব্যতীত কখনোই পরিপূর্ণ অর্থে ইসলামি মুদ্রাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন এবং কবুল করুন। আমিন।