• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

বাংলাদেশ যুদ্ধের বিভীষিকা ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন মেরিলিন

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯  

মেরিলিন সিলভারস্টোনকে বাংলাদেশে ক’জন মানুষ চেনে! চুয়াল্লিশ বছর আগে সাহসী এক তরুণী ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়িয়েছিলেন শরনার্থী শিবির থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে শুরু করে ঢাকার রাজপথে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম স্বাক্ষী সেই ফটোগ্রাফারের নাম মেরিলিন সিলভারস্টোন। ’৯৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিব্বতের এক মঠে মারা গেছেন তিনি। বাংলাদেশ যুদ্ধের বিভীষিকা তাকে এতটাই আপসেট করে দিয়েছিলো যে শান্তি খুঁজেছিলেন শান্তির ধর্মে- একমাত্র শ্বেতাঙ্গিনী সেবিকা হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটিয়েছেন হিমালয়ে। আমার মুক্তিযুদ্ধকালীন এলবামগুলোয় তার তোলা কিছু ছবি আছে। সবচেয়ে ছুঁয়ে গেছে আমাকে দুটো ছবি। দুটোই একইজনের। ৯দিনের এক শিশু। কুমিল্লা সীমান্ত পেরুতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা যায় তার মা। বুড়ো দাদা তার নাতিকে নিয়ে আশ্রয় নেন এক শরণার্থী শিবিরে। শিশুটি বাঁচেনি। ফেসবুক থেকে:

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। হঠাৎ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো খবরটা, শিয়ালবাড়ি খালের লাগোয়া ইটখোলার কাছে টাটকা এক বধ্যভূমির হদিস মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে সপ্তাহখানেক আগে অপহৃত বুদ্ধিজীবিদের ওখানেই হত্যা করে ফেলে রেখেছে ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) খুনীরা। গোটা ঢাকা ভেঙ্গে পড়লো রায়েরবাজারের সেই জংলাভূমিতে এবং তারা কেউ এমন নৃশংস দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। গত ন’মাস ধরে প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী হত্যা করা পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মমতার বিচারে রীতিমতো শিশু বলে রায় পেলো জামাতে ইসলামীর ক্যাডারদের নৃশংসতার কাছে। চোখ বাধা, হাত বাধা শরীরগুলোকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। মেরে ফেলার আগে অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতার সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিয়েছিলো গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদদের রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন এই আল-বদররা। যেন পন করেছিলো বুলেট বাঁচানোর।

পচা লাশের তীব্র দূর্গন্ধ আশে পাশের মাইলখানেক জায়গা জুড়ে। মেরিলিন সিলভারস্টোন যখন সেখানে পৌছলেন দেখলেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য। ওই দূর্গন্ধকে উপেক্ষা করেই লাশের মিছিলে প্রিয়মুখ খুঁজছে স্বজনরা। কিন্তু চেনার উপায় নেই। প্রতিটা লাশ বিকৃত করে ফেলেছিলো ইসলামের ঢাল নিয়ে মওদুদীবাদ কায়েমের লক্ষ্যে নামা মুসলমান নামের মুনাফিকগুলো। (স্মরণ করলে দেখবেন তাদের উত্তরসূরী শিবিরের হাতে নিহতদের ক্ষেত্রেও একইরকম সিগনেচার নৃশংসতা থাকে)। এদিক ওদিক পড়ে আছে অজস্র হাড়গোড়, মাথার খুলি। তার মানে অনেকদিন ধরেই এখানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী এসব উন্মাদ খুনে। (প্রসঙ্গত, মঈনুদ্দিন আশরাফের মতো কাদের মোল্লারও জবাই করে লাশ ফেলার ভেন্যু ছিলো শিয়ালবাড়ি)।

মেরিলিন মাঠের মাঝে পড়ে থাকা একটি কঙ্কালকে সামনে রেখে উৎকণ্ঠ স্বজনদের একটি ছবি নিলেন। ঢালের নীচে ইটভাটায় পড়ে থাকা লাশগুলোকে লেন্সে বাগাতে একটু নীচু জায়গায় নামতেই তাকে প্রথমবারের মতো টলিয়ে দিলো একটি দৃশ্য। একটি কুকুর খাচ্ছে বুদ্ধিজীবিদের একজনকে। মোট চারটি ছবি তুলেছিলেন মেরিলিন । রায়েরবাজার তার মনোজগতকে এমনই নাড়া দিয়েছিলো যে এই পেশাটাই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু ফেরার পর রেসকোর্সের বক্তৃতাই তার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। তারপর হিমালয়ের সেই মঠে চলে যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ এই ফটো্গ্রাফার।

স্মরণ করছি মেরিলিনকে, অকৃতজ্ঞ এক জাতির তরফ থেকে অশেষ শ্রদ্ধায়।