• বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১১ ১৪৩১

  • || ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

ভাষা সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার মহানায়ক

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বন্দি ছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু ১৯৫০ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে গুলি হয়। সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেক শহীদ রক্ত দেয়। বঙ্গবন্ধু তখনও বন্দি। বন্দি থাকা অবস্থায়ও ছাত্রদের সাথে সবসময় তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য ছাত্রসমাজকে উদ্বুদ্ধ করতেন।’ বস্তুত, ‘জেল থেকেই তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্রনেতাদের গোপনে দিকনির্দেশনা দিতেন।’ শুধু তাই নয়, তিনি ‘জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।’ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছেন:

১৯৫২ সালের একুশের আন্দোলনে তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। কারাগারে থেকে নানাভাবে তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ওই সময়টায় তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে, তাই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তখন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই ভবনে অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গভীর রাতে রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আলোচনা করতেন।

পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ১৯৫২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, চিকিৎসক, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন, আত্মীয়স্বজন অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করেছেন। ১৯৫১ সালের ১৩ নভেম্বরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই দিন সকাল ৯টায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তার কয়েকজন পুরনো বন্ধু, আনোয়ারা বেগম এমএনএ, খয়রাত হোসেন এমএনএ, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আহমদ হোসাইন এবং প্রায় ৩০ জন মেডিকেল ছাত্র তার সঙ্গে দেখা করেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ৩০ নভেম্বর ১৯৫১ তারিখে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান ও জনৈক নজরুল ইসলাম। তারা ৯টা ১৫ থেকে ৯টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় আব্দুস সালাম খান নামক এক গোয়েন্দা সদস্য একটু দূরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও, তারা কী বিষয়ে আলাপ করেন, তা শুনতে পাননি বলে ৩০ নভেম্বর, ১৯৫১ তারিখের গোপন গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন।

১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেবিনে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, আজিজ আহমদ; পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ; পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক চৌধুরী ও সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুুব। তারা সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয়ে নানা আলাপ করেন। এভাবে হাসপাতালের কেবিন থেকে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ‘পুলিশের নজরকে ফাঁকি দিয়ে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে দেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনা এবং ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে পরামর্শ প্রদান’ করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে বসেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকেন।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা সফরে এসে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উক্তি পুনর্ব্যক্ত করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে পূর্ববঙ্গের ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের আলোচনা হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং একুশে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের। কেবল তাই নয়, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বায়ক যাতে ছাত্রলীগ থেকেই করা হয়, সে বিষয়েও শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশনা দেন। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং বিভিন্ন ভাষণে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন: ‘আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের বারান্দায় ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। সেখানেই ঠিক হল, আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত গঠন করতে হবে।’

কারাগারের রোজনামচায় তিনি আরো স্পষ্ট করে লিখেছেন: ‘জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নাঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরো অনেকে গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।’ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গোলাম মাহবুবের আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়া, সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির শর্ত যুক্ত করা প্রভৃতি বিষয় পর্যালোচনা করলে এ বিবরণের বস্তুনিষ্ঠতা খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’ ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রাধান্য থেকেও এটা অনুধাবন করা যায়। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: ‘অনেকে ইতিহাস ভুল করে থাকেন। ১৯৫২ সালের আন্দোলনের তথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস আপনাদের জানা দরকার। আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসাধীন। সেখানেই আমরা স্থির করি যে, রাষ্ট্রভাষার ওপর ও আমার দেশের ওপর যে আঘাত হয়েছে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তার মোকাবেলা করতে হবে। সেখানেই গোপন বৈঠকে সব স্থির হয়।’

বস্তুত, ‘জেল থেকেই তিনি তাঁর অনুসারী ছাত্রনেতাদের গোপনে দিকনির্দেশনা দিতেন।’ শুধু তাই নয়, তিনি ‘জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন।’ এ প্রসঙ্গে ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বলেছেন: ‘১৯৫২ সালের একুশের আন্দোলনে তিনি জেলে বন্দি ছিলেন। কারাগারে থেকে নানাভাবে তিনি আন্দোলনের ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। ফেব্রুয়ারি মাসের ঐ সময়টায় তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে, তাই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তখন মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় একই ভবনে অবস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধু সে সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গভীর রাতে রাজনৈতিক বিষয় ও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নিয়ে আলোচনা করতেন।’

ভাষা আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং অন্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপ-আলোচনা ও দিকনির্দেশনা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। বদরুদ্দীন উমর, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, আহমদ রফিকসহ অনেকেই এর বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে মহিউদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, গাজীউল হক, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম আর আখতার মুকুল, শেখ আব্দুল আজিজ, জিল্লুর রহমান, কে. জি. মুস্তাফা, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী প্রমুখ ভাষাসংগ্রামী এবং মযহারুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, হারুন-অর-রশিদ, মুনতাসীর মামুন, আবু আল সাঈদ, নূহ-উল-আলম প্রমুখ গবেষক এর পক্ষে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

বদরুদ্দীন উমর পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তত্কালীন রাজনীতি গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার কথা অলি আহাদের বক্তব্য-সূত্রে পরোক্ষভাবে স্বীকার করলেও; পরবর্তীকালে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় তা সরাসরি নাকচ করে দেন। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য হলো: ‘শেখ মুজিব ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, যে সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকারীদেরকে বিপুল সংখ্যায় গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনেক সদস্য আত্মগোপন করে আছেন। এই পরিস্থিতিতে জেল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি লাভ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তত্কালীন ভাষা আন্দোলনে তার কোনো ভূমিকা ছিল না এবং আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মুক্তি দেয়াটা সরকার নিজেদের জন্য অসুবিধাজনক বা বিপজ্জনক কিছুই মনে করেনি।’ বদরুদ্দীন উমরের এ বক্তব্য খণ্ডিত। কারাগারে ছাত্রনেতারা যে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে ভাষা আন্দোলনে দিকনির্দেশনা নিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী ভাষা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে জেলখানা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়ে বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যকে যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করেছেন একুশের গান রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা প্রদান সম্পর্কে তিনি লিখেছেন: ‘ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের আগে থেকেই শেখ মুজিব জেলে ছিলেন। তিনি তার চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী জেল থেকে তার অনুগত সেপাইদের মাধ্যমে ছাত্রলীগের ও আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের কাছে গোপনে চিঠিপত্র পাঠিয়ে আতাউর রহমান-শামসুল হক গ্রুপের আন্দোলন-বিমুখতা সম্পর্কে সতর্ক করতে শুরু করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সরকার যদি ১৪৪ ধারা জারি করে, তাহলে আওয়ামী লীগ কমান্ডের নির্দেশ যাই হোক, ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীরা যাতে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়, সেই পরামর্শ দিতে থাকেন। সরকারি গোয়েন্দারা যখন টের পেল যে শেখ মুজিব জেলে বসে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার দল ও অনুসারীদের উৎসাহিত করছেন, তখন আকস্মিকভাবে তাকে ১৫ অথবা ১৬ তারিখে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ফরিদপুর জেলে বসেও তিনি চিরকুট পাঠান, যেটি একুশ তারিখে একটু দেরিতে ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে পৌঁছে।’

বদরুদ্দীন উমরের প্রত্যেকটি মত বিভিন্ন যুক্তি দ্বারা খণ্ডন করে একুশের গান রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আরো লিখেছেন: ‘উমরকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। বায়ান্ন সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারেকাছেও তিনি ছিলেন না। একটি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলে পদে পদে যে ভুল হয়, ১৪৪ ধারা সম্পর্কে উমরের বালখিল্য উক্তিই তার প্রমাণ।’

আবদুল মতিন এবং আহমদ রফিক নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকা এবং ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে ‘ইতিহাসের কল্পকাহিনী’ বলে অভিহিত করে লিখেছেন: ‘একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ দীর্ঘকাল পর বৃথাই একুশের আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে “মিথ” তৈরির চেষ্টা চলছে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে, সে চেষ্টা এখনো চলছে এবং এজন্য দায়ী কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ আহমদ রফিক তার ভাষা আন্দোলন: ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব (২০১৭) গ্রন্থে আগের বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে লিখেছেন: ‘দীর্ঘকাল পর বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) ভূমিকা সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা সঠিক তথ্য-নির্ভর ইতিহাস নয়। কেউ বলেছেন “১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশ তিনিই দিয়েছিলেন”, কেউ বলেন পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা তারই, আবার কেউ দাবি করেছেন “আন্দোলনের কর্মসূচি তাঁর কাছ থেকেই এসেছে”। দাবিগুলো এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসেছে যারা কমবেশি আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।’

আহমদ রফিক ও আবদুল মতিনের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাতে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, আছে ঢালাও মন্তব্য। তারা বলতে চেয়েছেন যে, ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারামুক্ত হয়ে কেন অসুস্থ অবস্থায়ই ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হলেন না? তাদের দাবি ভাষা আন্দোলন ‘তখনো চলছে’। এবং দুই মাস পর ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে’র সভায় শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তব্য দেন, তার ফলে তারা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার যুক্ত না থাকার ‘ঘটনা সঠিক’ বলে মনে করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন। তাদের এ বক্তব্য খণ্ডন করার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।

প্রথমত, তারা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ২৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ওই সময়কার ইত্তেফাক, ইনসাফ প্রভৃতি পত্রিকায় তার মুক্তির সংবাদ ছাপা হয়। ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নিরাপত্তা বন্দী জনাব মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ’ শিরোনামের সংবাদে বলা হয়: ‘রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র হইতে ঘোষণা করা হইয়াছে যে, বিখ্যাত নিরাপত্তা বন্দী জনাব মুজিবর রহমান খানকে [ভুলবশত খান বলা হয়েছে] গতকাল মুক্তি দান করা হইয়াছে।’ অর্থাৎ, শেখ মুজিব কারামুক্ত হন ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। প্রকৃতপক্ষে, ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তো ভাষা আন্দোলন চলমানই ছিল না, তাতে শেখ মুজিবুর রহমান যোগ দেবেন কী করে? ২৫ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভায় ‘২৬.২.৫২ তারিখ থেকে সাধারণ ধর্মঘট প্রত্যাহার’ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা ‘শহরের সর্বত্র স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু’ হয়।

দ্বিতীয়ত, ফরিদপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় এবং কারামুক্ত হয়ে তিনি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ছিলেন না। সমসাময়িক পত্রপত্রিকা ও শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা থেকে এ তথ্য জানা যায়। ঢাকায় গুলি চালনা ও ধরপাকড়ের সংবাদ শুনে শেখ মুজিবুর রহমান অতিশয় মর্মাহত হন এবং শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিবৃতি দেন। একই সঙ্গে তিনি দ্রুত ঢাকায় ফিরে আসার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেন এবং কিছুটা সুস্থ হয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় এসে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন এবং কারাবন্দিদের মুক্তির দাবি করেন। তিনি করাচিতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে বন্দিদের মুক্তির দাবি জানান। এছাড়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করান। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করেন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অলি আহাদ (পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে যোগ দেন) ভাষা আন্দোলনের দুই পর্বেই প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ হতো এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তা চলত। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন: ‘শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারী হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। চিকিৎসার কারণে সরকার তাঁহাকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করেন। প্রহরী পুলিশের ইচ্ছাকৃত নির্লিপ্ততার সুযোগ গ্রহণ করিয়া আমরা তাঁহার সহিত হাসপাতালেই কয়েক দফা দেখা করি। তিনি ও নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ই ফেব্রুয়ারী হইতে মুক্তির দাবীতে অনশন ধর্মঘট করিবেন, সেই কথা শেখ সাহেবই আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এই ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ফরিদপুর যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নারায়ণগঞ্জ নেতৃবৃন্দের সহিত শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ ঘটে।’

শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা হয়েছিল তখনকার মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র মির্জা মাজহারুল ইসলামের। তিনি শেখ মুজিবের পূর্বপরিচিত ছিলেন, তাই হাসপাতালে একাধিকবার তার চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। ওই সময়কার স্মৃতিচারণ করে তিনি লিখেছেন: ‘১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তাবন্দি অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমি তখন এই কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। দোতলায় ৮ নম্বর ওয়ার্ড-সংলগ্ন একটি কেবিনে তিনি থাকেন। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। রাউন্ড দেয়ার সময় প্রফেসরদের সঙ্গে আমরা যেতাম কিন্তু আমাদের কেবিনে প্রবেশ করতে দিত না। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পূর্ব সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় আমাদের মাঝে প্রথম পরিচয় হয়, পরে ঢাকা এসেও বহুবার দেখা হয়েছে। একদিন বঙ্গবন্ধু ‘এই মির্জা’ বলে আমাকে ডেকে তাঁর কেবিনের জানালার কাছে নিয়ে যান এবং ভাষা আন্দোলনের খোঁজখবর নেন। তিনি আমাকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।’

তখনকার গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন ভাষাসংগ্রামী ও গবেষকের সাক্ষাত্কার ও স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘ছাত্রনেতারা গোপনে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) সাথে দেখা করতেন। তাঁর মুক্তির জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিবৃতি দেন। নাইমউদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, অলি আহাদ ও মোহাম্মদ তোয়াহা দেখা করেন এবং তাঁরা ভাষা আন্দোলন বিষয়ে তাঁর সাথে পরামর্শ করতেন। সরকার তাঁকে হাসপাতালে বসে রাজনীতি করার অপরাধে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে এবং তাদের সুপারিশে তাঁকে অনেকটা সুস্থ বলে ঘোষণা দিয়ে আবার কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে থাকাকালে তিনি ও মহিউদ্দিন আহমদ চিঠি দিয়ে সরকারকে জানান, ১৫ই ফেব্রুয়ারি মুক্তি না দিলে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁরা অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন।’

এভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এক পক্ষ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা পুরোপুরি খারিজ করে দিয়ে বাহবা নিতে চেয়েছেন; অন্য পক্ষ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সব কৃতিত্ব তার কাঁধে তুলে দিতে চেয়েছেন। সম্প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তার সম্পর্কে প্রণীত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনসমূহ প্রকাশের পর ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা কী ছিল, তা দিবালোকের মতো সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় কারাগারে বন্দি অবস্থায় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের যোগাযোগ হয়েছে, সরাসরি কথা হয়েছে এবং তিনি আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এবং সে নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ও ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথে—নারায়ণগঞ্জে।

তাছাড়া কারাগার থেকে চিঠির মাধ্যমে, টেলিগ্রামের মাধ্যমে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরের পথে নারায়ণগঞ্জে এবং চিরকুট পাঠিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্রনেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, এটিও সত্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন, এটা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা-বিবৃতি ও সমকালীন পত্রপত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা করলেই প্রমাণিত হয়।

কারাগারে বসে তিনি এবং মহিউদ্দিন আহমদ ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করলে ভাষা আন্দোলন কর্মসূচিতে আসে উৎসাহ ও প্রেরণা। তাদের মুক্তির দাবি যুক্ত হয়ে ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি ভিন্ন মাত্রা পায়। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের সভায় যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি যুক্ত ছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসভা হয়। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনসহ সব রাজবন্দির মুক্তি দারি করে পোস্টারও দেয়া হয়।

সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়: ‘পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গী কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে দীর্ঘ কারাবাস ও বন্ধ দিনগুলির নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থ্যের জন্য উত্কণ্ঠার ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সকল রাজনৈতিক কর্মী—বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনের আশু মুক্তির প্রশ্নে পূর্ববঙ্গ পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে এক আবেদনপত্র পেশ করিয়াছেন। স্বাক্ষরকারীগণ বলেন—সর্বশক্তি নিয়োজিত করিয়া আপনারা পাকিস্তানে আইন ও নীতির শাসন, সৌভ্রাতৃত্ব ও গণতন্ত্র কায়েম করুন।...আসুন আসুন, আপনারা পরিষদের ভিতরে আর আমরা বাহিরে পূর্ববঙ্গের রাজবন্দীদের বিশেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনের মুক্তির দাবিতে আওয়াজ তুলি।’ কেবল রাজপথ এবং সভা-সমাবেশে নয়, বঙ্গীয় আইন পরিষদেও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবি তোলা হয়। তার ‘অনশন পালন বিষয়ে আলোচনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে আনোয়ারা খাতুন এমএলএ মুলতবি প্রস্তাব পর্যন্ত উত্থাপন করেছিলেন।’

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ‘মানবতার নামে’ শীর্ষক এক পৃথক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মুক্তির দাবি জানান। রাজবন্দিদের অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে ওই বিবৃতিতে তিনি বলেন: ‘আমি জানিতে পারিয়াছি যে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে নিরাপত্তাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। জনসাধারণ অবগত আছেন যে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন হইতে মারাত্মক রোগে ভুগিতে ছিলেন এবং কিছুদিন পূর্বে চিকিৎসার জন্য তাঁহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও স্থানান্তরিত করা হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহাকে রোগ মুক্তির পূর্বেই আবার জেলে প্রেরণ করা হয়। মহিউদ্দিনের স্বাস্থ্যও দ্রুত অবনতির দিকে যাইতেছে। এমতাবস্থায় আমরা সহজেই বুঝিতে পারিতেছি যে, এই অনশন ধর্মঘট তাঁহাদের ভগ্ন স্বাস্থ্যের পরিণতি ঘটাইবে। তাঁহাদিগকে আটক রাখার সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষের অনমনীয় মনোভাব দেখিয়া আমি অত্যন্ত মর্মাহত হইয়াছি। আমি মানবতার নামে সরকারের নিকট এই আবেদন করিতেছি যে তাঁহারা মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিনকে মুক্তিদান করেন।’

২৭ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে অত্যন্ত অসুস্থ শরীরেও তিনি গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণে প্রাণহানির ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বিবৃতি পাঠান এবং শহীদদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এরপর কিছুটা সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে এসে নিরাপত্তাবন্দিদের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে তিনি একটি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন: ‘আমি সাধারণ সম্পাদক হয়েই একটা প্রেস কনফারেন্স করলাম। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে এবং যাঁরা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান এবং যারা অন্যায়ভাবে জুলুম করেছে তাদের শাস্তির দাবি করলাম। সরকার যে বলেছেন, বিদেশী কোন রাষ্ট্রের উস্কানিতে এই আন্দোলন হয়েছে, তার প্রমাণ চাইলাম। “হিন্দু ছাত্ররা” কলকাতা থেকে এসে পায়জামা পরে আন্দোলন করেছে, এ কথা বলতেও কৃপণতা করে নাই মুসলিম লীগ নেতারা। তাদের কাছে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ছাত্রসহ পাঁচ-ছয়জন লোক মারা গেল গুলি খেয়ে, তারা সকলেই মুসলমান কি না? যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা নিরানব্বইজন মুসলমান কি না? এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল, একজনকেও ধরতে পারল না যে সরকার, সে সরকারের গদিতে থাকার অধিকার নেই।’