• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

মহামারিতে পণ্য গুদামজাতকরণ : ইসলামের সতর্কবার্তা

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২ এপ্রিল ২০২০  

ইসলাম মানবতার ধর্ম। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে জীবনের চাহিদাকে মূল্যায়ন করা হয় সমানতালে। কোনো কঠোরতার স্থান ইসলামে ছিল না, বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। কেউ করতে চাইলে তাকে ইসলাম বাধা দেয়। এখানেই ইসলামের আদর্শিক লড়াইটা। অন্যান্য ধর্ম ও মতবাদের সঙ্গে ইসলামের স্বাতন্ত্র্যতা এখানেই।

ইসলামে মানবজীবনের সবগুলো দিককে মূল্যায়ন করা হয় জীবনের দামে। কেউ এখানে রাজার হালতে কেউ প্রজার হালতে জীবনের পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারবে না। একারণেই জীবনকে শুধু ভোগের করেননি, আবার অভোগের পাত্রও বানাননি। তাই ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপনের পথকে নির্দেশ করেছেন গুরুত্ব দিয়ে। যেমন ঘোষণা হচ্ছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِن يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

‘নামাজ সম্পন্ন হলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করো।’ (সূরাতুল জুময়াহ, আয়াত : আয়াত ১০)।

এই আয়াতের সমর্থনে আমরা আরো একটি আয়াত উল্লেখ করতে পারি। আল্লাহ বলেন-

وَلَمَّا جَاءَهُمْ رَسُولٌ مِّنْ عِندِ اللَّهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِيقٌ مِّنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ كِتَابَ اللَّهِ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ كَأَنَّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

(হে নবী আপনি বলুন) হে আমাদের প্রভু! আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দান করো, আর আখিরাতেরও কল্যাণ দান করো। (সূরাতুল বাকারাহ, আয়াত : ২০১)। অন্য এক আয়াতে এই বিষয়টি আরো সুন্দর ও বাক্সময় হয়ে ফুটে ওঠেছে-

وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللَّهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ ۖ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا ۖ وَأَحْسِن كَمَا أَحْسَنَ اللَّهُ إِلَيْكَ ۖ وَلَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِي الْأَرْضِ ۖ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْمُفْسِدِينَ

‘পরকালীন জীবনে আল্লাহ আপনাকে যা দান করবেন, আপনি তা অনুসন্ধান করুন। কিন্তু পার্থিব জীবনে আপনার ন্যায্য অংশের কথাও আপনি ভুলবেন না। (সূরাতুল কাসাস, আয়াত : ৭৭)।

উল্লিখিত আয়াতগুলো সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামে জীবকা নির্বাহ ইবাদত সমান প্রাষঙ্গিক। তাই কোরআনে বারবার জীবিকা নির্বাহ করার আদেশ দিয়েছেন। নবী রাসূলদেরকে আমরা দ্বীনের কাজের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার নির্বাহের কাজেও সমান উপস্থিতি পেয়েছি। হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ ও কাপড় বোনার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। হজরত হুদ ও ছালেহ (আ.) ছিলেন কাপড় ও গৃহস্থালী পণ্যের ব্যবসায়ী। হজরত লুত (আ.) ও ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন একজন পাক্কা ব্যবসায়ী। হজরত শোয়াইব (আ.) পশু চরাতেন এবং বাজারে দুধ সরবরাহ করতেন। হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন একজন নামকরা লোহা ব্যবসায়ী ও লোহার যুদ্ধাস্ত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নির্মাতা। আর আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন বকরি পালনকারী ও বাজারের সওদাগার। 

জীবিকা নির্বাহের অনেকগুলো মাধ্যমের উন্নতর একটি মাধ্যম হলো ব্যবসা। এ ব্যবসার আবার রকমফের রয়েছে। এর মধ্যে একটি ব্যবসা হলো খাদ্যদ্রব্যের শস্যের ব্যবসা। এ ব্যবসা একটি উত্তম ব্যবসা। এই ব্যবসার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ! কেননা, তারা মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রের অনেক বড় গুরুত্ব পালন করছে। এটাই এমন এক ব্যবসা যার সঙ্গে প্রতিটি মানুষ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একারণে খাদ্য ব্যবসায়ীরা যদি একটু ব্যতিক্রম করে তাহলে তারা বেশি লাভবান হতে পারে। সব খাদ্য ব্যবসায়ীরা যদি জোট হয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয় তাহলে প্রতিটি মানুষ উচ্চ মূল্য দিয়ে তা কিনতে বাধ্য। ইসলাম এই বিষয়টা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। বিনা কারণে খাদ্যমজুদ করার পক্ষে না। বরং যারা জনগণকে কষ্ট দেয়ার জন্য খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে তাদের প্রতি ইসলামের কঠোর সতর্কতা রয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে করোনাভাইরাসের কারণে সব খাতের ব্যবসার মধ্যে চাপ বেড়েছে। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে একদল অসৎ ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি করেছে। যার দরুন মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত মানুষের জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। দিন আনে দিন খায়, এদের জীবন আজকে বিরাট হুমকির মুখে। অথচ ব্যবসায়ীদের একটু সদয় অনুভব ও একটু দয়ামান দিল হলে কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে এমন দুর্বিসহ আসে না। তাই এই কঠিন মুহূর্তে কেউ যেন অসর্তকতামূলকভাবে অথবা সচেতনার সঙ্গেই এমন গর্হিত কাজে জড়িয়ে না পড়ে।

রাসূলের (সা.) জমানায়ও এমন একদল ব্যবসায়ী ছিলো যারা সময়ে সময়ে অসৎ উপায়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকে কঠোরহস্তে দমন করতেন। তিনি (সা.) মদিনার উপকণ্ঠে বনুকায়নুকার বাজারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। এই বাজারের বৈশিষ্ট্য ছিলো এখানে কোনো রকম ধোঁকা প্রতারণা ঠকবাজি মাপে কমবেশি করা বা পণ্যদ্রব্য মজুদ অথবা আটক করে কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি করে জনগণকে কষ্ট দেয়ার সুযোগ ছিল না। শুধু তাই নয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সেই বাজারে প্রতিনিয়ত নজরদারি করতেন; কোনো ব্যবসায়ী অসৎ কোনো পথ অবলম্বন করেছেন কিনা! 

হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজার দিয়ে হাঁটছেন। এমন সময় এক ব্যবসায়ীর পণ্যস্তুপের মধ্যে হাত প্রবেশ করিয়ে দিলেন। তারপর দেখতে পেলেন ভেতরের পণ্যগুলো ভিজা, উপরেরগুলো শুকনো। অর্থাৎ ভেতরের পণ্যগুলো অনুপযুক্ত। অতঃপর রাসূল ওই ব্যবসায়ীকে বললেন, হে ব্যবসায়ী! এগুলো কী? তখন ব্যবসায়ী বললো, হুজুর! পণ্যগুলো বৃষ্টিতে ভিজে গেছে; তাই ভেতরে রেখে দিয়েছি। রাসূল বললেন, কেন তুমি ভিজা পণ্যগুলো উপরে রাখনি? যাতে সবাই দেখে বুঝে নিতে পারে। কেউ যেন ধোঁকার শিকার না হয়। অতঃপর রাসূল (সা.) কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন- 

عْن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال َمَنْ غَشَّنَا فَلَيْسَ مِنَّا 

‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেবে সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম : হাদিস নম্বর : ১০২)।

করোনা মহামারীর এই সময়টাতে কোনো ব্যবসায়ী ধোঁকা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে বাজারগুলোতে দিন দিন লাগামহীন মূলবৃদ্ধি করে চলছে। করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে নিজেদের ব্যবসাকে গরম করে তুলছে। সাধারণ সময় থেকে দুই তিনগুন বেশি ধরে পণ্য বিক্রি করছে। এদিকে সাধারণ নিন্মশ্রেণি ও মধ্যশ্রেণির মানুষের খাদ্য কিনতে হাপিয়ে উঠছে। নুন আনতে যার পানতা ফুরায় তার অবস্থা এখন নাভিশ্বাস! 

সুতরাং মহামারির এই সময়ে আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদের কাছে নিবেদন থাকবে তারা যেন হাদিসে বর্ণিত ব্যবসায়ী নির্দেশনাগুলো পালন করে। দেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় প্রতিজন ব্যবসায়ীর বিরাট সুযোগ দেশের জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করার। আল্লাহ জানে কারোনাভাইরাসের দাপট কতোদিন থাকবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক। আমিন।