• বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৪ ১৪৩০

  • || ১৭ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

রাজধানীতে ডাকাতির নেপথ্যে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

রাজধানীতে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ডাকাতির ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ। পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে মিলেমিশে নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংগঠনের তহবিল সংগ্রহের জন্য জঙ্গিরা আগেও ডাকাতি ও ছিনতাই করেছে। নতুন করে তাদের আবার ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলো। সম্প্রতি এসব ডাকাতির ঘটনায় নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ কয়েক কোটি টাকার মালামাল লুট করে নিয়েছিল ডাকাত দলের সদস্যরা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

গোয়েন্দা ও সিটিটিসি সূত্র জানায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে এ মাস পর্যন্ত রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন হাজীপাড়া, মগবাজার, দিলুরোড, মগবাজার ও মালিবাগ এবং শেরে বাংলা নগর থানাধীন পান্থপথ ও রাজাবাজার এলাকায় অন্তত ছয়টি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এসব ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারাও ব্যাপক হিমশিম খাচ্ছিল। অবশেষে একটি প্রতিষ্ঠানের খাবার সরবরাহকারী এক প্রতিনিধির সূত্র ধরে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পাঁচ জন পেশাদার ডাকাত সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। হাড্ডি মোরশেদ, কবির হোসেন মনা, জাহিদ শেখ, আরমান হোসেন ও রাসেল নামের এই পাঁচ ডাকাতকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা। জিজ্ঞসাবাদে এই পাঁচ ডাকাত তাদের সঙ্গে ডাকাতিতে নেতৃত্ব দেওয়া রহস্যজনক এক যুবকের তথ্য জানায়। পরে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পেশাদার ডাকাত চক্রের সদস্যদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হৃদয় নামে রহস্যজনক ওই যুবককে শনাক্তের পর ডাকাতির ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পারে।

হৃদয়

হৃদয়

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া পেশাদার ডাকাত দলের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পেয়ে তারাও বিষয়টি নিয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করেছেন। তদন্তে পেশাদার ডাকাত চক্রের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানার পর ডাকাতিতে অংশ নেওয়া জঙ্গি সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালাচ্ছেন।

জঙ্গি প্রতিরোধে গঠিত সিটিটিসির উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সাম্প্রতিক কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় আমরা জঙ্গি সম্পৃক্ততার কিছু তথ্য পেয়েছি। আগেও জঙ্গিরা ডাকাতি ও ছিনতাই করে তহবিল সংগ্রহ করতো। এখন আবার এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে যাওয়া জঙ্গি সদস্যদের গ্রেফতারে ও ডাকাতি প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, ১৯ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হওয়া পেশাদার পাঁচ ডাকাতের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) নাহিদ ও অর্ণব নামে এই ডাকাত চক্রের দুই তরুণ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে নাহিদ ও অর্ণব গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছে, এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তারা পান্থপথ, মগবাজার ও দিলু রোডের তিনটি বাসায় ডাকাতির ঘটনায় অংশ নিয়েছিল। তাদের ওই বড় ভাই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। তাদেরকেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বলতো। রহস্যজনক ওই বড় ভাই তাদের সঙ্গে প্রয়োজনের বাইরে কোনও কথা বলতেন না। এমনকি ওই বড় ভাই কোথায় থাকেন বা কী করেন সেসম্পর্কে কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি।

সূত্র জানায়, তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা রহস্যজনক ওই বড় ভাইকেই হৃদয় বলে শনাক্ত করেছেন। হৃদয়ের বিষয়ে প্রাথমিক কিছু তথ্য পাওয়ার পর তার জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। তবে তদন্তের স্বার্থে তার বিস্তারিত পরিচয় ও জঙ্গি সংগঠনের নাম প্রকাশ করেননি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ডাকাতি করে বেড়ানো ওই জঙ্গি সদস্য ও তার একাধিক সহযোগী বর্তমানে গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। যেকোনও সময় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। 

লোভে পড়ে ডাকাতিতে দুই তরুণ
লোভে পড়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া দুই তরুণ ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এদের একজন অর্ণব হাসান ঢাকার আইডিয়াল কলেজ থেকে চলতি বছরেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। আর নাহিদ হোসেন ঢাকা ওরিয়েন্টাল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। জিজ্ঞাসাবাদে এই দুই তরুণ জানিয়েছে, তারা নাখালপাড়ার বাসিন্দা ও ছোটবেলার বন্ধু। মাস ছয়েক আগে আরেক বন্ধুর মাধ্যমে রহস্যজনক এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। জঙ্গি দলের সদস্য হৃদয় নামে ওই বড় ভাই হাতিরঝিল এলাকায় একাধিকবার তাদের সঙ্গে বৈঠক করে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যৌথভাবে ডাকাতি করার প্রস্তাব দেয়। অর্ণব ও নাহিদ তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে তিনটি ডাকাতির ঘটনায় অংশ নিয়েছিল বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অর্ণব ও নাহিদ জানিয়েছে, রহস্যজনক ওই বড় ভাইয়ের সঙ্গে তারা ছাড়াও হাড্ডি মোরশেদ, কবির হোসেন মনা, জাহিদ শেখ, আরমান হোসেন, রাসেল, রুবেল ও সোহেলসহ আরো অনেকেই ছিল। ওই বড় ভাই ডাকাতি করতে বাসা নির্বাচন করে রেকি করে আসতো। তারপর সে যাদের যাদের ডাকতো তারা একসঙ্গে ডাকাতি করতে যেত। পান্থপথ, দিলু রোড ও মগবাজারের একটি বাসায় ডাকাতির আগে ওই বড় ভাই তাদের ডেকেছিল। ডাকাতির পর তাদের নগদ টাকা থেকে ভাগ ও স্বর্ণালংকার বিক্রির পরও টাকার ভাগ দিত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অর্ণব ও নাহিদের হেফাজত থেকে লুট করে নেওয়া প্রায় দশ ভড়ি স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অর্ণব ও নাহিদ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অর্ণবের বাবা আবুল হাসনাত মহাখালীতে মটর পার্টসের ব্যবসা করেন। নাহিদের বাবা সরকারি বিজি প্রেসে চাকরি করেন। নাহিদের ভাই-বোনেরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। এরকম পরিবারের সন্তানেরাও অস্ত্র হাতে কীভাবে ডাকাতির মতো অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন সেটিও তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো ডাকাতি করে সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে আসছে। ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিওতে ডাকাতি করে বেড়াত। ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল আশুলিয়ায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতি করে জেএমবির সদস্যরা। ২০১৮ সালে বগুড়া জেলা পুলিশ বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতারের পর উত্তরাঞ্চরের বিভিন্ন জেলায় ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জঙ্গিদের নতুন করে সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানতে পারে। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মোজাফফর আলী ওরফে শাহীন নামে এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে সিটিটিসি ইউনিট। শাহীন পলাতক অবস্থায় ডাকাতি করে সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রেহর চেষ্টা করছিল।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, নতুন করে সংগঠিত হওয়ার পাশাপাশি জেলে থাকা জঙ্গিদের পরিবারের সদস্যদের সংসার খরচ, মামলা পরিচালনাসহ সংগঠনের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করতে তহবিল সংগ্রহ করে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। আগের মতো এখন সমর্থকদের কাছে অর্থ সহায়তা না পাওয়ায় জঙ্গিরা ডাকাতি করে তহবিল সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। জঙ্গিদের ভাষায়, বিধর্মী বা অসৎ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া টাকা কথিত জিহাদের পথে খরচ করা তারা বৈধ মনে করে।