• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

সংকটে খাদ্যনিরাপত্তায় স্বপ্ন দেখাচ্ছে ব্রি ধান ৮৭

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৯ নভেম্বর ২০২২  

তখনো ভোরের কুয়াশার রেশ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। সকালের মিষ্টি রোদে চকচক করছিল পাকা ধানের শিষ। সেইসঙ্গে বাতাসে যখন শিষগুলো দোল খাচ্ছিল তা দেখে মন না জুড়িয়ে উপায় নেই। এ যেন মাঠের পর মাঠ জুড়ে পাকা ধানের মেলা।

নাটোরের বাগাতিপাড়ার বাশবাড়িয়ার এই এলাকায় আগে আখের চাষ হতো। কিন্তু নাটোরের সুগার মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই এলাকার কৃষকরা এখন ধানের আবাদ করছেন। কিন্তু গত কয়েক আবাদে তারা খুব সুবিধে করতে পারেনি। যে ধানই আবাদ করেছেন ফলন আশানুরূপ হয়নি। এছাড়া কোনো কোনো জাতের ধানের আবাদের সময় বেশি লাগায় অন্য ফসল আবাদ করা যায় না। ফলে লোকসান গুনতে হয় কৃষককে।  কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এই এলাকার বেশির ভাগ কৃষকই এবার আবাদ করেছেন ব্রি ধান-৮৭। অনেক কৃষক আম বাগানের ফাঁকা জায়গায় এই ধান আবাদ করেছেন। তাতে আম বাগানও ঠিক আছে, আবার ধানের আবাদও করতে পারছেন।

কৃষকরা জানিয়েছেন, ব্রি -৮৭ ধানের গাছগুলো শক্ত, শিষ বড়। বাতাসে হেলে পড়ে না। পোকার আক্রমণ নেই। জীবনকালও কম। হেক্টর প্রতি সাড়ে ৭ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে এই ধান প্রতি মণ ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করছেন বলে তারা জানান।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আমাদের জমি কম। কিন্তু সে তুলনায় খাদ্যের চাহিদা বেশি। তাই এমন ধানের আবাদ করতে হবে, যাতে কম সময়ে অধিক ফলন পাওয়া যায়। সম্প্রতি সরেজমিনে রাজশাহীর নাচোল, নাটোরের বাগাতিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ব্রি ধান-৮৭ আবাদের এ চিত্র দেখা যায়। মাঠেই কথা হয় কৃষকদের সঙ্গে। নাটোরের বাগাতিপাড়ার বাশবাড়িয়ার কৃষক মো. আফাজ উদ্দিন বলেন, এবার আমি ১৪ বিঘা জমিতে ব্রি ধান-৮৭ আবাদ করেছি। এতো ভালো ফলন আমি আমার জীবনে দেখিনি। এ ধানের গাছগুলো শক্ত, শিষ বড়। বাতাসে হেলে পড়ে না। পোকার আক্রমণ নেই। জীবনকালও কম। হেক্টর প্রতি সাড়ে ৭ টন ফলন পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি। আফাজ উদ্দিন বলেন, এই জাতের ধান গাছ তুলনামূলক লম্বা হওয়ায় কম্বাইন্ড হারভেস্টার দিয়ে কাটা সুবিধে হয়। মেশিন দিয়ে কাটায় সময় কম লাগে। খরচও বাঁচে। তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় ২৪/২৫ মণ করে ধান পাচ্ছি। দেখতে চিকন ও লম্বাটে হওয়ায় দামও অন্যান্য ধানের চেয়ে বেশি।

শিক্ষিত তরুণ কৃষক মেহরাজুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, রাজধানীর ডেফডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি পাস করার পর কিছুদিন চাকরি করেছেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে এখন তিনি আবাদ করছেন। চলতি আমন মৌসুমে তিনি ১০ বিঘা জমিতে ব্রি ধান- ৮৭ আবাদ করেছেন বলে জানালেন।

তরুণ এই কৃষক বলেন, এক সময় স্বর্ণা ধান চাষ করতাম। কিন্তু স্বর্ণা ধান বেশ মোটা। ফলনও কম। রোগে আক্রান্ত হয়। তাই কৃষি বিভাগের পরামর্শে এবার ব্রি ধান-৮৭’র আবাদ করেছি। তিনি বলেন, আমাদের কয়েক জনের দেখাদেখি এই এলাকার প্রায় সবাই এবার ব্রি ধান-৮৭ আবাদ করেছেন। আর ফলন ভালো পাওয়ায় খুশি তারা। তিনি বলেন, এই ধানের চাল বেশ চিকন। তিনি এবার প্রতি মণ ব্রি-৮৭ ধান ১ হাজার ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন বলে জানালেন। এই এলাকার আরেক কৃষক জামাত প্রামাণিক বলেন, এক সময় আম বাগান সারা বছর খালি পড়ে থাকতো। কিন্তু এখন আম বাগানেই ব্রি-৮৭’র আবাদ করছি। তিনি বলেন, এই ধানের গাছ বেশ শক্ত হওয়ায় কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আমের পাশাপাশি ধানও পাওয়া যাচ্ছে। কৃষক আনিসুর রহমান বলেন, ব্রি-৮৭ ধানের জীবনকাল কম হওয়ায় তিনি এই ধান আবাদ করে একই জমিতে অন্য ফসলও করতে পারছেন। এ বিষয়টাই তার কাছে সবচেয়ে বেশি লাভজনক মনে হচ্ছে।

ব্রি’র রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে ৮৩৭টি ব্লক আছে। প্রতিটি ব্লকে এক বিঘা করে জমিতে প্রদর্শনী করার জন্য বীজ ও সার সহায়তা দিয়েছে সরকার। সেইসঙ্গে কৃষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। ব্রি’র এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, আমন ধান ব্রি-৮৭ আবাদ করার পর কৃষকরা এই জমিতে রবিশস্য সরিষা, মসুর ও আলু চাষ করতে পারবেন। এরপর এখানেই বোরো আবাদ করতে পারবেন। তার মানে, চাষের জন্য আমনের জাতটা নির্বাচন করা কৃষকের জন্য খুবই জরুরি। আমন জাত নির্বাচন সঠিক হলে একজন কৃষক একই জমিতে তিন বার ফসল করতে পারবেন। এতে কৃষক লাভবান হবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমন ব্রি-৮৭ ধান আবাদ করতে কৃষকের ১২৫ দিন লাগবে। এরচেয়ে কম সময়ে আর কোনো আমন আবাদ করা সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, আমাদের উদ্ভাবিত ১০৮টি জাতের মধ্যে অনেকগুলোই উচ্চ ফলনশীল। তিনি বলেন, জীবনকাল কম হওয়ায় ও ফলন বেশি হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্রি—৮৭ ধানটির আবাদ সম্প্রসারণে কাজ করছে কৃষিবিভাগ। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্রি’র আরো তিনটি জাত উন্মুক্ত হবে বলে তিনি জানান।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, উচ্চ ফলনশীল হওয়ায় আমরা ব্রি-৮৭ ধানের আবাদ বাড়াতে কাজ করছি। এ ধান চাষ করতে পারলে একই জমি থেকে ধান উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।