• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১২ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

যে ইতিহাস বারবার জানা দরকার

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৫ মার্চ ২০২৩  

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঠান্ডা মাথায় নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও ঘুমন্ত সাধারণ বাঙালির ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল—তা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার নজির। স্বাধীনতাকামী মানুষ যেন শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে না পারে, সেই ষড়যন্ত্র নিয়েই এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। যদিও তারা মনোবল ভেঙে দিতে পারেনি। ওই দিনের তাণ্ডব স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে শোক কমে আসে ঠিকই, কিন্তু সেখান থেকে শক্তি অর্জনে ও জাতি হিসেবে শিরদাঁড়া শক্ত করতে কী কী ঘটেছিল সেইদিন, তা বারবার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা। দরকার নানা ভাষায় এসব ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়া।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এরপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আর একের পর এক প্রতিরোধ চলতে থাকে দেশব্যাপী। বাংলার মানুষ তখন কেবলই স্বাধীনতা চায়। ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দিনের পর দিন আলোচনা চলে। কিন্তু সমাধানের কোনও পথ মেলে না। দিন যত যায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে। বাংলার মানুষের সেই চাওয়া শুরুতেই ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া-ভুট্টো গং মিলে প্রস্তুতি নেয় গণহত্যার। ঢাকায় চালানো ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

এদিন সকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে একান্ত বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিস্থিতি সংকটজনক’।

ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া গোপনে বৈঠক করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, মেজর জেনারেল মিঠঠা খান, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ উচ্চপদস্থ সেনাকর্তাদের সঙ্গে।

প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান কোনও ঘোষণা ছাড়াই গোপনে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি বিমানবন্দরে চলে যান। তিনি নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নামতেই পূর্ব পাকিস্তানে তৎপর হয়ে ওঠে তার বাহিনী। এদিকে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগের খবর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। রাত ৯টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় আমাদের পথ আমাদেরই দেখতে হবে। সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

দাবানলের মতো ঘরে ঘরে খবর পৌঁছে যায় যে ইয়াহিয়া ‘ঢাকা ছেড়ে পাকিস্তান পালিয়ে গেছে’। বাঙালি বুঝে ফেলে কিছু একটা ঘটবে। রাতেই পথে নেমে আসে ছাত্র-জনতা এবং গড়ে তোলে অসংখ্য ব্যারিকেড।

রাতের শুরুটা যেমন ছিল

বিকাল থেকেই পাকিস্তানি সেনারা হেলিকপ্টারে টহল দিতে থাকে। সব ধরনের সামরিক সংস্থার সদস্যদের বার্তা দিতে থাকে— অবশ্যম্ভাবী এক সামরিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত থাকতে। রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে আর্মির একটি বড় কনভয় যুদ্ধসাজে শহরের দিকে রওনা হয়। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে সারা দেশের জেলা ও সাব-ডিভিশনে বেতারবার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে।

একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআরের ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। পিলখানায় ইপিআরে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারী বাজারসহ সমগ্র ঢাকাতে শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পিত পুরো শহর।

আটক হলেন বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার সম্পর্কে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে সৈয়দ বদরুল আহসান রচিত ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে। রাত ১টার পর পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অনেকেই আত্মগোপনে যেতে বললেও বঙ্গবন্ধু যাননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।’ লেখকের বর্ণনায়, ‘কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছাতেই সেনা সদস্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। শেখ মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সদস্য গুলিতে মারা যান।’  বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ করো।’

সাংবাদিক বি জেড খসরু তার ‘মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘গুলি বন্ধ হওয়ার পর কর্নেল খান বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢোকেন। দোতলায় যান। মুজিব একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ‘শেখ মুজিবকে কর্নেল নির্দেশ দেন তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কিনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।’

কী দেখেছিলেন বিদেশি সাংবাদিকরা?

ওই সময় ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ছিলেন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই সে সময় ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করা হয়। সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের বলে, শহরের পরিস্থিতি খুব খারাপ, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের হোটেলের ভেতরেই অবস্থান করতে হবে। অবরুদ্ধ বিদেশি সাংবাদিকরা সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। পরদিন সকালেই তাদের বিমানবন্দরে নিয়ে তুলে দেওয়া হয় উড়োজাহাজে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা।

একাত্তরের ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত সাইমন ড্রিংয়ের প্রতিবেদনটি ছিল এরকম—‘পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় সব সদস্যও গ্রেফতার হয়েছেন। নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা হয় গ্রেফতার হয়েছেন, নতুবা মারা গেছেন। মুজিবের আন্দোলনকে সমর্থনকারী দুটি পত্রিকার অফিস ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। তবে মনে হয়, ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার বুকে চড়াও হওয়া ট্যাংকগুলোর প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল ছাত্ররা।’

পরে মেজর সালিক যা জানালেন

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর সিদ্দিক সালিক পরবর্তীকালে লিখেছেন, ‘ওই রাতে মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষকে আমরা গ্রেফতার করে এনেছিলাম। পরে চাকরবাকরদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’

গ্রেফতারের তিন দিন পর বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয় উল্লেখ করে মেজর সালিক লিখেছেন, ‘পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম—গ্রেফতার করার সময়েই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল, জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন, যেকোনও উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করতে হবে।’

টিক্কা খানের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক পরে ‘উইটনেস টু স্যারেন্ডার’ বইতে লিখেছেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণকবরগুলো জরিপ করছিলাম। সেখানে আমি তিনটি ঢিবি দেখতে পাই, যার প্রতিটি ৩ থেকে ১৫ মিটার ডায়ামিটারের ছিল। সেগুলো নতুন মাটিতে ভরাট করা। কিন্তু কোনও অফিসার মৃতের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে রাজি ছিল না। আমি দালানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। বিশেষত ইকবাল ও জগন্নাথ হলের, যেগুলো আমার মনে হলো—অ্যাকশনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

২৫ মার্চের গণহত্যার প্রোপার ডকুমেন্টেশন আমরা করতে পেরেছি কিনা প্রশ্নে শহীদ বুদ্ধিজীবী সন্তান তৌহিদ রেজা নূর বলেন— ‘এ বিষয়ে নানা ধরনের ডকুমেন্টেশন হয়েছে সত্য। কিন্তু আরও বিস্তৃত ও গবেষণাভিত্তিক ডকুমেন্টেশন  জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম,  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠান—প্রতিটি ক্ষেত্রে বছরব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণামূলক ও প্রচারণামূলক কর্মকাণ্ড রাখা দরকার।  মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা কাজের সঙ্গে আগ্রহী তরুণদের ব্যাপক হারে যুক্ত করা দরকার। তথ্যপ্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে দেশে,  ফলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তথ্যভিত্তিক নানা আইটেম অডিও ভিজ্যুয়াল ফর্মে সাইবার জগতে নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা দরকার। তবে এই কাজ হতে হবে সমন্বিতভাবে। সঠিক তথ্য ও ইতিহাসের উপাদান নিশ্চিত করতে ওয়াকিবহাল ও যোগ্য একটি টিমের ছায়াতলে সার্বিক কাজ বাস্তবায়ন করা জরুরি। ’

‘নতুন প্রজন্মের আগ্রহ রয়েছে ব্যাপক’, উল্লেখ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘ডকুমেন্টেশন অনেক রকমের হয়েছে। এখন রাষ্ট্র ও সরকারের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় গবেষণাগুলো ছড়িয়ে যায়। মাঝের একটা প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি। এখনকার ছেলেমেয়েরা জানার চেষ্টা করলে, তাদের সামনে অনেক অপশন। এখন দরকার তথ্যগুলো নানাবিধ ভাষায় তুলে ধরা। আমরা যদি ডকুমেন্টগুলো বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে না পারি, তাহলে গণহত্যা দিবস ঘোষণার যে দাবি, তা পূরণ হবে কীভাবে? সেখানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’