• শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪ ||

  • চৈত্র ১৫ ১৪৩০

  • || ১৮ রমজান ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৬ অক্টোবর ২০২২  

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পঞ্চগড় জেলা থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য মেলে ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রকৃতিপ্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের দুহাত বাড়িয়ে ডাকছে। কুয়াশাবিহীন মেঘমুক্ত নীলাকাশে অক্টোবরের শেষ সময় থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পঞ্চগড়ের বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। গত কদিন ধরে ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার মায়াবী রূপলাবণ্য। কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় মনোমুগ্ধকর শোভা উপভোগ করতে হাজারো ভ্রমণপিপাসু প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটক আসছেন পঞ্চগড়ে। পর্যটকদের নির্বিঘ্ন ভ্রমণে নিরাপত্তা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।

পঞ্চগড় জেলার পশ্চিম উত্তর কোণে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের পিরামিডটিই কাঞ্চনজঙ্ঘা। কদিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার পরিজন নিয়ে পর্যটকরা আসছেন পঞ্চগড়ে। স্পষ্টভাবে খালি চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখছেন পর্যটকরা। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতের সিকিম ও নেপালজুড়ে অবস্থিত হলেও আকাশ পথে কম দূরত্বের কারণে ৮,৫৮৬ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন কাঞ্চনজঙ্ঘা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার পরপরই সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুক, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও একাধিক গ্রুপে ছবি ও ভিডিও আপলোড হতে থাকে। ফেসবুকে নানান গল্প-স্মৃতি নিয়ে দুর্লভ ছবি দিয়ে পোস্ট করেন অনেকেই। এরপর থেকে পর্যটকদের ঢল নামে তেঁতুলিয়ায়। ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে কালচে, এরপর লালচে হয়ে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

 

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

 

সকাল হতে না হতেই সফেদ সাদায় রূপ নেয়। দুপুরের পর কোনও কোনও সময় দেখতে পাওয়া যায় না। তবে শেষ বিকেলে গোধূলির আলোয় লালচে রূপ ধারণ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা, যা সন্ধ্যা অবধি দেখা যায়।

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার সময়গুলোতে তেঁতুলিয়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলন মেলা বসে। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধদের পাদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। মহানন্দা নদীর পাড়ে বসে থাকা, কারও সেলফি তোলা, ভিডিও করা, পর্যটকদের যত্রতত্র হাঁটাচলা, মহানন্দা নদী থেকে শত শত মানুষের পাথর উত্তোলনের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন উৎসব চলছে। আবাসন সংকট, সন্ধ্যার পর পাবলিক বাহন, বিশেষ করে বাস চলাচল না থাকাসহ পর্যটন কেন্দ্রিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে না ওঠায় অনেক পর্যটককে দুর্ভোগও পোহাতে হয়। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

তেঁতুলিয়ার বাসিন্দা শামীম রেজা বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার সংবাদ ফেসবুকে পেয়েই পর্যটকরা বিশেষ করে রাইডাররা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি তেঁতুলিয়ায় আসতে শুরু করেন। রিকশা-ভ্যানের পাশাপাশি এখানে কার, মাইক্রো, বাসে করেও পর্যটকরা বেড়াতে আসছেন। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঘিরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। যা জেলার অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তেঁতুলিয়া সদরের অটো ভ্যানচালক সাইদুল বলেন, এই মৌসুমে শত শত মানুষ এখানে আসে। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি তারা দলবেঁধে চা বাগান, রওশনপুরের আনন্দধারা, জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখতে যান। এ সময়টাতে আমাদের ভালো আয় হয়। অনেকে ভাড়ার পাশাপাশি বকশিশও দেয়।

ডাকবাংলোর পাশের দোকানদার শেখ ফরিদ ও হাবিব বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার মৌসুমে প্রচুর পর্যটক  আসেন। এসময় বেচাবিক্রিও বেড়ে যায়। বিশেষ করে আবাসিক হোটেল, খাওয়ার হোটেল, পান সিগারেটের দোকান, ছোট ছোট খাওয়ার দোকান, বিভিন্ন যানবাহন চালকসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয় বেড়ে যায়।

জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার হাবিব ও শাহীন জানান, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার পর থেকে ভিড় করছেন পর্যটকরা। ডাকবাংলোগুলো আগাম বুকিং হয়েছে। আবাসিক হোটেলগুলোতেও সিট খালি নেই। পর্যটকদের যে পরিমাণ চাহিদা সে পরিমাণ আসন এখানে নেই। অনেকে তেঁতুলিয়ায় রাতযাপন করতে না পেরে পঞ্চগড় শহরে চলে যাচ্ছেন।

কুমিল্লা থেকে আসা মিজানুর রহমান বলেন, প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটক কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল, সান্দাকফু বা ফালুটে যান। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাদের খুব একটা সামর্থ্য নেই তারা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পান। এটি সৃষ্টিকর্তার উপহার। 

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

নাজনীন আক্তার নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, দিনের বেলায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা শেষে সন্ধ্যার পর মহানন্দার পাড়ে বসে সীমান্ত লাইট ও শৈল শহর দার্জিলিংয়ের পাহাড়ের ওপরের নিয়ন বাতি জ্বলতে দেখা যায়। তাদের ঘরবাড়ি, যানবাহন চলাচলও দেখা যায়, যা অসাধারণ লাগে।

ঢাকা থেকে পরিবারের সঙ্গে এসেছেন সানজিদা শবনম। তিনি জানান, প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা জার্নি করে এখানে এসেছি। আসার পর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পেরেছি। খুবই ভালো লাগছে। পরিবারের সবাই মিলে এনজয় করছি।

রংপুর থেকে আসা মোতালেব ইসলাম বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ না আসলে বলে বোঝানো যাবে না। অনেকে একাধিকবার এসেও দেখতে পায় না। আমরা এসেই দেখতে পেরেছি, এটা সৌভাগ্য। আমি বান্দরবান গিয়েছি, সিলেট গিয়েছি, অনেক পাহাড় দেখেছি, বাট কাঞ্চনজঙ্ঘার যে ভিউ এটা সত্যিই ডিফারেন্ট।

দিনাজপুর থেকে আসা শাহরিয়ার রহমান বলেন, অনেক দিন ধরে প্ল্যান চলছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসবো। এবার পরিবারসহ এসেছি। এতটা স্পষ্ট দেখবো আশা করিনি। আমরা অভিভূত।

অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আরিফ মাহমুদ বলেন, প্রবাসে থাকি। প্রতিদিন মা ও মাটির টানে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আসা হয় না, ঘোরাও হয় না। এবার তেঁতুলিয়ায় এসে কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করে আমি মুগ্ধ। প্রথম প্রহর থেকেই খুব ক্লিয়ারলি দেখা গেছে। আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করা খুবই কঠিন। এটা শুধু অনুভব করার মতোই, বলার মতো না। সত্যিই অসাধারণ।

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা নাজমুল হুদা শাহ অ্যাপোলো বলেন, মাঝে মাঝে ভারতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। তবে তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার বিষয়টি অন্যরকম। এত ক্লিয়ার ও সুন্দর ভিউ দেখতে পাওয়া আনন্দের। তেঁতুলিয়ায় যদি আরও কিছু স্থাপনা হয় তাহলে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তেঁতুলিয়া বাংলাদেশের বুকে স্থান করে নেবে।

ঢাকা থেকে আসা সাবিহা বলেন, খুব সুন্দর মনোরম দৃশ্য। দেখে খুব ভালো লাগছে। অসংখ্য পর্যটকের আগমন ঘটেছে। এখানে কিছু সমস্যাও আছে, যেগুলো পর্যটকদের বিড়ম্বনায় ফেলছে। তেঁতুলিয়ায় থাকার জায়গা না হলে এখান থেকে পঞ্চগড় জেলা শহরে ফিরে আসার কোনও যানবাহন পাওয়া যায় না। অনেক দুর্ভোগ নিয়ে ফিরে আসতে হয়।

ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আসফিয়া সাবিনা বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। অপেক্ষা করতে হয়নি। ভোরে নেমেই এত সুন্দরভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ উপভোগ করেছি। এত সুন্দরভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে পাবো এটা ধারণাই করিনি।

টুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম বলেন, সারা বছরই পর্যটকরা তেঁতুলিয়ায় আসেন। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাওয়ার মৌসুম ও শীতকালে এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রদান করে যাচ্ছি। যেকোনও সমস্যায় পর্যটকরা টুরিস্ট পুলিশের সহযোগিতা পাবেন।

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ্ বলেন, আবহাওয়া অনুকূল থাকলে মেঘ বা কুয়াশামুক্ত আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধ রূপ স্পষ্ট দেখা যায়। এবার সেপ্টেম্বরে মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিয়েছিল। তবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিষ্কারভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার সাপেক্ষে নভেম্বর পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা তার রূপলাবণ্য পর্যটকদের জন্য মেলে ধরবে।  

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, তেঁতুলিয়া উপজেলার মহানন্দা নদীর পাড়, জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, মাগুরমারী বিজিবি ক্যাম্পের সামনে, তেঁতুলিয়া থানার পেছন থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সবচেয়ে ভালোভাবে উপভোগ করা যায়।

পঞ্চগড় এম আর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. দেলওয়ার হোসেন সরকার বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ শীত মৌসুমে প্রচুর পর্যটক পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ায় আসেন। আবাসন ও যানবাহন স্বল্পতা পর্যটকদের জন্য বড় সমস্যা। সরকারি বেসরকারি যেসব হোটেল মোটেল রয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। পর্যটকরা আসার আগেই বুকিং দিয়ে থাকেন। এখানে থাকার সুযোগ না পেলে তাদের অনেককে পঞ্চগড় জেলা শহরে গিয়ে রাতযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে সন্ধ্যার পর পঞ্চগড়ে ফেরার জন্য তাদের অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পর্যটন শিল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে কক্সবাজারকে ঘিরে সরকারের যে পরিকল্পনা আছে ঠিক তেঁতুলিয়াকে ঘিরেও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।

তেঁতুলিয়ায় উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা

পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অসংখ্য পর্যটক আসছেন। টুরিস্ট পুলিশ ও জেলা পুলিশের মাধ্যমে আমরা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। পঞ্চগড় জেলা পুলিশের পক্ষ পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে আরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভ্রমণপিপাসুদের পঞ্চগড়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের সব নিরাপত্তা পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, সরকারি ডাকবাংলোর পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এবং বিভিন্ন এনজিওর হোটেল মোটেল রয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের জন্য এখানে কমিউনিটি ট্যুরিজম চালু রয়েছে। এখানকার যেকোনও ফ্যামিলির সঙ্গে টুরিস্টরা এসে মিশে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করে। এই সময়টাতে এখানকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়ের খাত তৈরি হয়। যেটি পঞ্চগড়ের অর্থনীতিকে দিনের পর দিন চাঙা করছে।