• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

আমদানি নির্ভরতা কাটবে পাম অয়েল আবাদে

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ২৯ জানুয়ারি ২০১৯  

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভোজ্যতেল হলো পাম অয়েল। এটি মূলত আফ্রিকান অয়েল পাম গাছের (elaeis guineensis) ফলের শাঁসের মধ্যত্বক থেকে উৎপাদন হয়। সত্তরের দশকে প্রথম বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে পাম অয়েল। ওই সময়ের পর থেকে দেশের বাজারে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভোজ্যতেলটি। দেশে পাম অয়েলের বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হয় ভোজ্যতেলটি। ইনডেক্স মুন্ডির তথ্য বলছে, বর্তমানে বৈশ্বিক পাম অয়েল আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। গত বছরও দেশে পণ্যটি আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন। এ বিপুল পরিমাণ পাম অয়েল আমদানি করতে গিয়ে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য দেশে বৃহদায়তনে পাম গাছ আবাদের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবেই পণ্যটির উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এতে একদিক থেকে যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে, তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থানও।

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেসব জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে পাম গাছ রোপণ করা হয়েছে, সবখানেই ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এ দেশের পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসংবলিত যেকোনো জায়গায় পাম আবাদ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এখানকার আবহাওয়ায় ফসলটির উৎপাদনশীলতাও বেশি। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন কিছু পরিমাণে পাম আবাদও হচ্ছে। সফলতা এসেছে প্রায় সবখানেই। সর্বনিম্ন ২২-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাযুক্ত আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় এ ফসল সবচেয়ে ভালো জন্মায়। দিনে উজ্জ্বল সূর্যালোকের প্রয়োজন হয় ৫-৬ ঘণ্টার। সর্বোচ্চ বর্ধনশীলতার জন্য বাতাসে আর্দ্রতা প্রয়োজন হয় ৮০ শতাংশ। এছাড়া এর জন্য বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন পড়ে বার্ষিক আড়াই থেকে সাড়ে চার হাজার মিলিমিটার। এদিক থেকে বাংলাদেশের আবহাওয়া পাম আবাদের জন্য অত্যন্ত চমত্কারভাবে উপযোগী।

বাড়তি পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার করা হলে পাম আবাদের জন্য সাধারণত সেচের তেমন একটা প্রয়োজন পড়ে না। তবে খরা দীর্ঘায়িত হয়ে উঠলে সেচের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এখন অতিবৃষ্টি ও খরা দুই ধরনের সমস্যাই মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এজন্য সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থাপনা ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে পাম আবাদের ক্ষেত্রে অতিবৃষ্টি ও খরা দুটোরই নেতিবাচক প্রভাব কাটানো সম্ভব। তবে পাম গাছ আবাদের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার নিষ্কাশন সুবিধাসংবলিত জমি নির্বাচন করা জরুরি। কারণ অতিরিক্ত সময় জলাবদ্ধতায় থাকলে গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় পাম গাছের আবাদ সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখন বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কারণ এটি পাহাড়ধস, মাটির ক্ষয়রোধ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর প্রমাণিত। কারণ পাম গাছের শিকড় দীর্ঘ ও শাখা-প্রশাখাযুক্ত।

বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ পাম গাছ রোপণের তিন-চার বছরের মধ্যেই ফলন দিতে সক্ষম হয়ে ওঠে। এ ফলন পাওয়া যায় একটানা ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত। নিয়মিত পরিচর্যা করা হলে একেকটি গাছ থেকে বছরে ফলের ৮-১০টি কাঁদি আহরণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাম চাষ করে একেকটি কাঁদির ওজন পাওয়া গেছে ৪০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত, যেখানে পণ্যটি উৎপাদনে অন্যতম শীর্ষ দেশ মালয়েশিয়ায় একেকটি কাঁদির ওজন পাওয়া যায় মাত্র ২০-২৫ কেজি। বাংলাদেশে একেকটি চার-পাঁচ বছর বয়সী পাম গাছ থেকে বছরে কমপক্ষে ৪০ কেজি পাম অয়েল পাওয়া সম্ভব। পাম গাছের ফল থেকে পাম অয়েল আহরণের সময় যে উপজাত বা বর্জ্য পাওয়া যায়, সেটিকেই পাম বাগানে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এছাড়া জৈব পদ্ধতিতে অন্যান্য ফসল আবাদের ক্ষেত্রে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার কমানোর বালাই নিয়ন্ত্রক হিসেবেও পাম গাছ রোপণ করা যায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রতিকূল আবহাওয়াসহিষ্ণু পাম গাছ অন্যান্য বৃক্ষের তুলনায় ১০ গুণ বেশি অক্সিজেন দেয় বলেও মত রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণও করে বেশি। এছাড়া জ্বালানিসাশ্রয়ী ফসল হিসেবেও এর যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে।

সরকারের কৃষি তথ্যসেবার (এআইএস) দাবি, একেকটি পাম গাছ থেকে মাসে গড়ে আয় হয় ১ হাজার টাকা। সে হিসাবে ফসলটির আবাদ করে ঘরে বসেই একরপ্রতি ১ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া একটি পরিবারের সারা বছরের তেলের চাহিদা পূরণের জন্য দুটি গাছই যথেষ্ট বলে দাবি করছে এআইএস। পাম চাষের আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, এর মাটি থেকে আহরিত পুষ্টি উপাদান ফিরিয়ে দেয়ার সক্ষমতা। পাম গাছের প্রতি টন শুকনো পাতা মাটিতে সাড়ে ৭ কেজি নাইট্রোজেন, ১ দশমিক শূন্য ৬ কেজি ফসফরাস, ৯ দশমিক ৮১ কেজি পটাশিয়াম ও ২ দশমিক ৭৯ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ফিরিয়ে দেয়। এ কারণে পাম গাছ পরিবেশবান্ধব হিসেবেও স্বীকৃত।

ভোজ্যতেল উৎপাদনের বাইরে পাম অয়েল এতদিন পর্যন্ত সাবান ও ডিটারজেন্ট, গ্রিজ, লুব্রিক্যান্টস ও মোমবাতি প্রস্তুতে ব্যবহার হয়ে এসেছে। সাম্প্রতিককালে জৈব জ্বালানি উৎপাদনেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে খনিজ তেলের বিকল্প হিসেবেও এর ব্যবহার শুরু হওয়ার কথা জানা গেছে। এছাড়া পাম অয়েল থেকে পাওয়া ফ্যাটি অ্যাসিড উপাদানগুলোও এখন ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী, কসমেটিক, ওষুধ শিল্প ও পানি পরিশোধনকারী উপাদান তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে। স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও পাম অয়েলের বেশ উপযোগিতা রয়েছে। স্যাচুরেটেড ফ্যাটের উৎস হিসেবে এর ব্যবহার এড়ানোর বা সীমিত করার পক্ষে মত দিয়ে এসেছেন সমালোচকেরা। এক্ষেত্রে রক্তে কোলেস্টেরল বাড়ানোয় স্যাচুরেটেড ফ্যাটের ভূমিকায়ই তারা জোর দিচ্ছেন বেশি।

তবে এ যুক্তি নিখাদ নয় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পাম অয়েলের মধ্যকার স্যাচুরেটেড ফ্যাট আসলে মূলত পামিটিক অ্যাসিড। এ পামিটিক অ্যাসিড রক্তে লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এলডিএল) কোলেস্টেরলের (ক্ষতিকর কোলেস্টেরল) মাত্রা কিছুটা বাড়ায়, এ কথা সত্য। কিন্তু তা একই সঙ্গে আবার হাই-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (এইচডিএল) কোলেস্টেরলের মাত্রাও কিছু পরিমাণে বাড়ায়। ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনুপাতে এর প্রভাব তেমন একটা থাকে না। উপরন্তু পাম অয়েলের স্যাচুরেটেড ফ্যাটের গঠন এমন, দেহ পামিটিক অ্যাসিড খুবই অল্প পরিমাণে শুষে নিতে পারে। এছাড়া মানবদেহ পাম অয়েল থেকে যে চর্বিটুকু শুষে নেয়, তা আসলে মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট, যা হূদযন্ত্রের জন্য স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। সে হিসেবে দেহে পাম অয়েলের ক্ষতিকর প্রভাব সয়াবিন তেল বা কর্ন অয়েলের তুলনায় অনেক কম।

তবে পাম গাছের আবাদ সম্প্রসারণ করতে চাইলে একটি কথা অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। সেটি হলো, এদিক থেকে শীর্ষ দুই উৎপাদনকারী দেশ মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে কোনোভাবেই অনুসরণ না করা। বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশবান্ধব বৃক্ষটির আবাদ সম্প্রসারণ করতে গিয়ে ব্যাপক হারে বন পুড়িয়ে উজাড় করে দিয়েছে দেশ দুটি। শুধু পাম আবাদের জন্য বন উজাড় করতে গিয়ে দেশ দুটি এখন শীর্ষ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে। এছাড়া দেশ দুটির আকাশও এখন প্রায়ই আচ্ছন্ন থাকে ধোঁয়ায়। এছাড়া এর আবাদ সম্প্রসারণ করতে গিয়ে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ওপর যাতে চাপ না পড়ে, সে বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া জরুরি।