• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

বড়দের ঋণ মেয়াদহীন ৯৩% আমানত সর্বোচ্চ দুই বছরের

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ১৬ মার্চ ২০২৩  

বড় গ্রাহকদের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে দেশের ব্যাংকঋণ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নিজেদের শীর্ষ তিন গ্রাহক খেলাপি হলে ন্যূনতম মূলধন সক্ষমতা (সিআরএআর) হারাবে দেশের অন্তত ১৬টি ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যাংকগুলো এখন বড় গ্রাহকদের ঋণ নিয়মিত রাখার চেষ্টা করছে। ঋণসীমার পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে ঋণের মেয়াদও। সব ধরনের ব্যাংকিং রীতিনীতিতে ছাড় দিয়ে বড় গ্রাহকদের স্বল্পমেয়াদে দেয়া ঋণের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে বারবার। যদিও দেশের ব্যাংক আমানতের ৯৩ শতাংশেরই মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই বছর।

বিশ্বের যেকোনো দেশে শিল্প খাতে প্রকল্প বা মেয়াদি ঋণ আসে পুঁজিবাজার থেকে। আবার বন্ডের বাজার থেকেও আসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মেয়াদি ঋণ। যদিও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। দেশের কৃষি, এসএমই থেকে শুরু করে ভারী শিল্পের সিংহভাগ ঋণই আসছে ব্যাংক থেকে। চলতি মূলধনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ঋণেরও মূল উৎস এখনো ব্যাংক। পুঁজিবাজারের ভিত শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন আরো ভঙ্গুর হয়ে উঠছে। দেশে বন্ডের বাজার সে অর্থে এখনো গড়েই ওঠেনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানত ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই বছরের বেশি মেয়াদি আমানত ছিল ৭ শতাংশেরও কম। অথচ দেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশের মেয়াদই দুই বছরের বেশি। স্বল্পমেয়াদি হিসেবে পরিচিত ঋণও অনাদায়ী থাকায় সেগুলো দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তর হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্পদ ও দায়ের এ অসামঞ্জস্য দেশের ব্যাংক খাতকে নাজুক করে তুলেছে। ব্যাংকের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা আরো বাড়লে পুরো খাতই ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দায় ও সম্পদের বিদ্যমান অসামঞ্জস্যকে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের এক অধিবেশনে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেছে। এতে দায় ও সম্পদের অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। এজন্য খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

ওই অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, ‘মূলধন জোগান দিতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে নিয়ম-কানুনগুলো আরো পর্যালোচনা করতে হবে। শেয়ারবাজার উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের নীতিসহায়তা দেবে।

ব্যাংকিং মডেলের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পরিস্থিতিও বাংলাদেশের মতো। সম্প্রতি ভারতের পরিসংখ্যান কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রণব সেন এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘ভারতের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের গড় মেয়াদ নয় বছর। যদিও আমানতের মেয়াদ দুই-আড়াই বছর। সম্পদ ও দায়ের এ অসামঞ্জস্য যেকোনো সময় ভারতীয় ব্যাংক খাতে “বিস্ফোরণ” হয়ে দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘শিডিউলড ব্যাংক স্ট্যাটিস্টিকসের’ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। মোট ১৩ কোটি ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ব্যাংক হিসাবে এ আমানত জমা রেখেছেন গ্রাহকরা। সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ অর্থ মেয়াদি আমানত (ফিক্সড ডিপোজিট) হিসেবে জমা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯৮ হাজার ৫২০ কোটি টাকার আমানতের মেয়াদ ছিল দুই বছরের বেশি। অর্থাৎ, দেশের মোট আমানতের মাত্র ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ দুই বছরের বেশি মেয়াদি।

মেয়াদি আমানত ছাড়াও দেশের ব্যাংকগুলোয় চলতি ও নগদ হিসাবে আমানত জমা রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এটি মোট আমানতের ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। সঞ্চয়ী হিসাবে আমানত জমা রয়েছে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬০ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। বিশেষ নোটিসের আমানত বা এসএনডি হিসাবে জমা রয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। এসব আমানত যেকোনো সময় গ্রাহক তুলে নিতে পারেন। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদে এসব আমানত থেকে ঋণ দেয়া যেকোনো ব্যাংকের জন্যই বিপজ্জনক।

কোনো ব্যাংক থেকে একই সঙ্গে সব গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নেন না। এজন্য চলতি ও সঞ্চয়ী হিসাবে থাকা আমানত, মেয়াদি আমানতসহ বিভিন্ন ধরনের আমানতকে হিসাবায়ন করে ‘কোর ডিপোজিট’ বের করে ব্যাংকগুলো। দেশের ব্যাংকগুলোর কোর ডিপোজিটের হার ২০-৩০ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতিটি ব্যাংক মনে করে, তার কাছে থাকা আমানতের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ গ্রাহকরা যখন-তখন ফেরত চাইবেন না। যদিও দেশের ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশের মেয়াদ দুই বছরের বেশি।

বিকল্প কোনো উৎস না থাকার কারণে গ্রাহকরা ব্যাংক থেকেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে পুঁজিবাজার বলতে সে অর্থে কিছু নেই। আবার এনবিএফআই ও বন্ডের বাজার নিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এ কারণে ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদে ঋণ বিতরণ না করলে দেশে শিল্প গড়ে উঠত না।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ছয় মাস মেয়াদি এলটিআরের মেয়াদও দুই বছর হয়ে যাচ্ছে। চলতি মূলধনের ঋণ যথাসময়ে ব্যাংকে ফিরে আসছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায়ের অসামঞ্জস্য বাড়ছে। আমানতকারীরা আরো বেশি হারে নগদ টাকা তুলে নিতে চাইলে ব্যাংক খাত বিপর্যয়ে পড়বে। সে পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এজন্য ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরো দৃঢ় করতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে করপোরেট সুশাসন মেনে চলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে ঋণ বিতরণ করাই যেকোনো ব্যাংকের মৌলিক কাজ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের সবক’টি তফসিলি ব্যাংক মোট ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৯০৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে শিল্প খাতে। এর মধ্যে সব ধরনের শিল্পে মেয়াদি ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। চলতি মূলধন হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে শিল্পে মোট ঋণের ২০ শতাংশ। অর্থের পরিমাপে শিল্প খাতে বিতরণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।

মোট ব্যাংকঋণের ৩৫ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে ট্রেড অ্যান্ড কমার্স খাতে। এছাড়া ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোক্তাঋণে, ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ নির্মাণ খাতে, ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ কৃষি খাতে, ২ দশমিক ১১ শতাংশ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ও দশমিক ৮৬ শতাংশ ঋণ যানবাহনে বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।

দেশে আমদানি বা রফতানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুললে সে দায় সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে ঋণপত্রের দায় ফোর্স লোনে রূপান্তর হচ্ছে। শিল্পে চলতি মূলধন দিলে সেটিও যথাসময়ে ফেরত আসছে না। মেয়াদি ঋণসহ সব ধরনের ঋণই খেলাপি হলে ১৫ বছরের জন্য তা পুনর্গঠন হচ্ছে। পুনর্গঠিত ঋণও পুনঃতফসিল হচ্ছে ১০ বছরের বেশি সময়ের জন্য। গাড়ি বা বাড়ি কেনার মতো রিটেইল ঋণের মেয়াদও তিন থেকে ১৫ বছর। অথচ ব্যাংকগুলোর আমানতের মাত্র ৬ দশমিক ২৫ শতাংশের মেয়াদ দুই বছরের বেশি। সম্পদ ও দায়ের মেয়াদের মধ্যে এ অসামঞ্জস্যকে ব্যাংকাররা দেশের ব্যাংক খাতের জন্য বড় ধরনের মিসম্যাচ হিসেবেই দেখছেন।

স্বল্পমেয়াদি ঋণও দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তরের ঘটনা ব্যাংক খাতে নিয়মিত ঘটছে। আমদানিকারকদের লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট (এলটিআর) ঋণ দেয় ব্যাংক। বিশ্বাসের ঋণ বলে পরিচিত এ ঋণের মেয়াদ হয় তিন থেকে ছয় মাস। এসব ঋণ দেয়া হয় আমদানি করা পণ্য বাজারজাত করে ব্যাংকের দায় পরিশোধের শর্তে। সর্বোচ্চ ছয় মাসের জন্য দেয়া এলটিআর ঋণের মেয়াদ আর শেষ হচ্ছে না। অপরিশোধিত এসব ঋণের মেয়াদ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অর্থ ফিরে না আসায় এসব ঋণ উঠছে ব্যাংকের খেলাপির খাতায়।

ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলীও মনে করেন, দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তিন মাস মেয়াদি আমানত থেকে ১০ বছরের জন্য ঋণ দেয়া হচ্ছে। সে ঋণও যথাসময়ে ফেরত আসছে না। ১৫ বছরের জন্য পুনর্গঠনকৃত খেলাপি ঋণ আবারো পুনঃতফসিল করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য কখনই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

ব্যাংক খাতে সম্পদ ও দায়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতে হলে বিনিয়োগের বিকল্প উৎসগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে বলে জানান এ ব্যাংকার। তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রধান উৎস হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি বন্ডের বাজার ও এনবিএফআইগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা এসব দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ আমরা লক্ষ করিনি। বিনিয়োগের বিকল্প উৎস ঠিক না করলে ব্যাংকের সম্পদ ও দায়ে সামঞ্জস্য ফিরবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বর্তমানে খেলাপি। তবে পুনর্গঠন, পুনঃতফসিল ও অবলোপনকৃত ঋণ হিসেবে ধরলে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশই দুর্দশাগ্রস্ত। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে বিশেষ পুনঃতফসিল নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণখেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাউন পেমেন্ট ছাড়াও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছেন।

ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারে যান। বন্ডের বাজারও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো এ দুটি বাজার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যাংক খাতে সম্পদ ও দায়ের সামঞ্জস্য ফেরাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার কারণেই সেটি সম্ভব হচ্ছে না।