• শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

অবিশ্বাস-কোন্দলে ভঙ্গুর কৃষক দল

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ৫ এপ্রিল ২০২১  

কৃষি ও কৃষকনির্ভর বাংলাদেশেও অত্যন্ত ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে রয়েছে বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী কৃষক দল। দীর্ঘ ২২ বছর পর গত ১২ মার্চ সংগঠনটির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিনই সংগঠনের নতুন কমিটি ঘোষণার নিয়ম থাকলেও তিন সপ্তাহ পরও তা সম্ভব হয়নি।

বরং অভিযোগ উঠেছে, কাউন্সিলকে ঘিরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। নতুন কমিটি গঠন ছাড়া ফখরুলকে দিয়ে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে আহ্বায়ক কমিটি।

কাউন্সিল নিয়ে তিনি কোথাও ৪০ লাখ কোথাও ৭০ লাখ টাকা খরচের কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এর আগে তিনি একটি সংগঠনের সদস্য সচিব, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেখানে ৬৬ জন সদস্যের মধ্যে ৬১ জন তার বিরুদ্ধে বলেছে। এমন জনপ্রিয় লোককে আমরা পেয়েছিলাম।

সূত্র জানায়, কৃষক দলের সদ্য বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিনের বোঝাপড়ার অভাব এবং দূরত্বের কারণে এই সংগঠন এখন ভঙ্গুরদশায় পড়েছে। এক্ষেত্রে হাসান জাফির তুহিনকেই দুষছেন নেতাকর্মীদের একটি অংশ।

১২ মার্চ সকালে রাজধানীর গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে কাউন্সিলের প্রথম সেশনের উদ্বোধন করা হয়। আর দ্বিতীয় সেশন হয় সেদিন বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে। শেষ পর্বে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন। তাদের সামনেই রাত ১১টার দিকে একদল কর্মী হট্টগোল ও মারামারিতে জড়ায়। তখন কক্সবাজার জেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক তারিকুল ইসলামও মারধরের শিকার হন। এই ঘটনায় হাসান জাফির তুহিনের সমর্থকদের অভিযুক্ত করা হয়। যদিও প্রতিপক্ষের দাবি, এরা বহিরাগত।

পরে অবশ্য কাউন্সিলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কৃষক দলের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। নতুন কমিটি গঠন ছাড়া এই ঘোষণা নিয়মবহির্ভূত হিসেবে সমালোচিত হয়।

সেই মারামারির ঘটনাসহ কৃষক দলের বর্তমান ভঙ্গুর দশার জন্য হাসান জাফির তুহিনকে দোষারোপ করেন সংগঠনটির এক দশকের বেশি সময়ের দফতরের দায়িত্ব পালনকারী এস কে সাদী। তিনি  বলেন, ‘সবই ঠিক ছিল। নেতৃত্বে কে থাকবে সে সিদ্ধান্ত দেবে হাইকমান্ড। এর আগেও এমন হয়েছে। আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদু নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবকিছু করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন সবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছেন। দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। কাউন্সিল নিয়ে তিনি কোথাও ৪০ লাখ কোথাও ৭০ লাখ টাকা খরচের কথা বলে বেড়াচ্ছেন। এর আগে তিনি একটি সংগঠনের সদস্য সচিব, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সেখানে ৬৬ জন সদস্যের মধ্যে ৬১ জন তার বিরুদ্ধে বলেছে। এমন জনপ্রিয় লোককে আমরা পেয়েছিলাম!’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষক দলের নেতৃত্ব সহনশীল, কিন্তু তুহিন সাহেব তাদের আস্থা রাখতে পারেননি। সম্মেলনের দিন দুদু (শামসুজ্জামান দুদু) ভাই বলেছিলেন, কারও ব্যক্তিগত নাম ধরে যেন স্লোগান দেয়া না হয়। কিন্তু আমাদের সদস্য সচিব পাবনা থেকে প্রায় তিন হাজার লোক নিয়ে আসেন যাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর। তাদের হলে বসিয়ে সম্মেলন চলাকালে মাঝে মাঝে ‘তুহিন ভাই এগিয়ে চলো’ স্লোগান দেয়া হয়েছে। সেখানে কাউন্সিলররা বসতে পারেননি, সিট পাননি। আবার তিনি জেলা নেতাদের বলেছেন, শুধু তার নামই বলতে হবে, আর কারও নাম বলা যাবে না।’

এস কে সাদী বলেন, ‘তুহিন সাহেবকে নেতারা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সভাপতি হিসেবে তার পছন্দের এমন একজনকে চাইছেন, যাকে সংগঠনের কেউই চায় না। কিন্তু তার পছন্দের ব্যক্তি সংগঠনের সভাপতি হচ্ছে না, এমন পূর্বাভাস পেয়েই তিনি হট্টগোল সৃষ্টি করেন। চর দখলের মতো, আওয়ামী লীগের ভোটকেন্দ্র দখলের মতো করে তিনি সেদিন (কাউন্সিলের সময়) চেয়ারপারসনের কার্যালয় দখলে নেন। আমাদের কাউন্সিলরদের ঢুকতে দেননি, শারীরিকভাবে কাউকে কাউকে লাঞ্ছিতও করা হয়েছে।’

ক্ষমতাসীন দলের এক ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে তার সখ্য নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে সাদী বলেন, ‘গুলশানের মতো জায়গায় তিনি চার বাস লোক নিয়ে কিভাবে ঢুকলেন? আবার তিনি সম্মেলনে ৪০ থেকে ৭০ লাখ টাকা খরচের কথা বলেছেন। এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন? কোথায় খরচ করলেন?’

বিশৃঙ্খলার জন্য তুহিন একাই দায়ী কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে সাদী বলেন, ‘অবশ্যই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তিনিই দায়ী। তিনি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং তারেক রহমানের সঙ্গে কাউন্সিল নিয়ে প্রতারণা করেছেন। এখন ব্যাপারটা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পর্যায়ে রয়েছে। আমরা অপেক্ষায় আছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কৃষক দলের সার্বিক পরিস্থিতি তারেক রহমানের নজরে রয়েছে। ২২ ধরে কাউন্সিল না হওয়া, কৃষক দলকে জনমুখী হিসেবে দাঁড় করাতে না পারাসহ সার্বিক বিষয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা হচ্ছে। কৃষক দলকে সুসংগঠিত করতে সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান, আমীরুজ্জামান খান আলীম, নাজিম উদ্দিন আলম এবং ঢাকা মহানগরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আবদুস সালাম ও আবদুল আউয়াল মিন্টুকে নেতৃত্বে আনার বিষয়ে হাইকমান্ডের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একটি ঘনিষ্ট সূত্রের দাবি, কৃষক দলের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনে পুরনো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে সাবেক ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে আনার বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কৃষক দলে অভিজ্ঞ এবং সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে দায়িত্ব দেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। ঈদের আগে না হলেও ঈদের পর কৃষক দল একটি নতুন ও গতিশীল কমিটি পেতে পারে।

সূত্র জানায়, সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান (বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা) তার বর্তমান দায়িত্বে কোনো পারফরম্যান্স দেখাতে পারছেন না। তিনি কৃষক দলে কতটুকু কাজ করতে পারবেন সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি দলীয় হাইকমান্ডের কাছে এখন তিনি যে দোষে দুষ্ট, অন্য দায়িত্বেও তার প্রভাব থাকবে কি-না, সেটাও সংশয়ে রাখছে।

আবদুস সালাম দীর্ঘদিন ঢাকা মহানগরের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তাকে মুক্তিযোদ্ধা দলে রাখার আলোচনা রয়েছে। কারণ মহানগরেই তার পারফরম্যান্স নেই। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা দলের হয়ে তিনি কথা বলতে পারবেন।

এছাড়া নাজিম উদ্দিন আলম এবং আমীরুল ইসলাম খান আলীম হাইকমান্ডের কাছে আগ্রহ দেখালে তাদেরও বিবেচনা করা হতে পারে। কৃষক দলের নেতৃত্ব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন আলম এবং আমীরুজ্জামান খান আলীম দুজনই জানান, ‘দল দায়িত্ব দিলে কৃষক দলের প্রতি তাদের আগ্রহ রয়েছে।’

কৃষক দলের বর্তমান সংকট নিয়ে যার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ সেই সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিন গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে তার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেন নি। একাধিকবার বার্তা পাঠালেও তার কোনো উত্তর তিনি দেননি।

সংগঠনের সদস্য সচিব হাসান জাফির তুহিনকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি আহ্বায়ক শামসুজ্জামান দুদুও। তিনি বলেন, ‘কাউন্সিল হয়েছে। একটু জটিলতা দেখা দিয়েছে। কমিটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

বিএনপির অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলোর চেয়ে কৃষক দলের তৎপরতা কতটুকু রয়েছে জানতে চাইলে দুদু বলেন, ‘কৃষক দল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংগঠন। আর বন্ধু সংগঠনগুলো জনসাধারণের দল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্যসহ সার্বিক সফলতার জন্য কৃষক দল কাজ করে থাকে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কৃষি দ্রব্যমূল্যের দামে ন্যায্যতা নিয়ে এসেছিলেন। সারের দাম কমিয়েছিলেন। কৃষকদের অনেক দাবিকে তিনি আইনের আওতায় এনেছিলেন।’

কৃষক দলের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘কৃষক দলের নতুন কমিটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

কাউন্সিলে কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা সভাপতি বা আহ্বায়কের সঙ্গে আলোচনা করে দেয়ার নিয়ম থাকলেও সেদিন শামসুজ্জামান দুদুর সঙ্গে আলোচনা না করেই তা হয়েছিল কি-না, জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, ‘নিয়ম আছে যে কোনো কাউন্সিল হলে পুরাতন যারা থাকে তাদের রিজাইন করতে হয় এবং পুরাতন কমিটি ভেঙে দিতে হয়। আগের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন কাউন্সিলের পর কমিটিতে যারা থাকে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়।’