• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

কাছ থেকে দুরে, দূর থেকে কাছে শেখ মুজিব

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ১৭ আগস্ট ২০১৯  

‘শেখ মুজিবের নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায়।’ বর্ণালী-বিচ্ছুরিত এই সাদামাটা পঙক্তিটি আমার নয়, স্নেহাস্পদ বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের এক বক্তৃতায় যথা-প্রতিধ্বনি।

কতো অর্থে না ‘ইতিহাসের দরজা’ শব্দটি কর্ণপটে এসে বাড়ি মেরে যায়।

সব মানুষের কাছে ইতিহাস পৌঁছায় না। তার প্রমাণ তো এই ভূখণ্ডের মুসলমানগণ। নিজেদের স্বরূপ সম্পর্কে তাদের অন্ধতা দোজখের অন্ধকারকে হার মানিয়ে দেয়। ধর্ম জাতীয়তার অন্যতম উপাদান হতে পারে, কখনই নিয়ন্ত্রক বা নিয়ামক নয়।

একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র নির্মাণের হুজুগে মেতে উঠে বাঙালি মুসলমানেরা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলল। তারা এগিয়ে না এলে পাকিস্তান হতো না। কারণ তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠদের আচরণ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠদের অধম ... এমনই হীনমন্যতার (ইনফেরিঅরিটি কমপ্লেক্স) শিকার। ধর্ম তো মর্মশক্তি। মানুষকে জৈবিক পর্যায় থেকে মানবিক পর্যায়ে উন্নীত করে, বুকে মহত্বের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয়। এই ক্ষেত্রে দেখা গেল, ইসলাম ধর্ম তথা পাকিস্তানের নামে এই ভূখণ্ডের অধিবাসীরা এমনই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য যে ইতিহাসের কাছেই গেল না।

ধর্মের আবাকাবা পরিহিত শাসকেরা যখন রাওয়ালপিণ্ডিতে ম্যালেরিয়া গবেষণা কেন্দ্র খুলল, যেখানে ওই রোগে ভোগে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী তখনও এই ভূখণ্ডের মুসলমানদের চোখ খুলল না, প্রতিবাদও করল না। কারণ, নৈতিকতার মাজা ধর্মের নামে ভাঙা।

এই রাজনৈতিক পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চোখ খুলল না, প্রতিবাদও করল না। কারণ, নৈতিকতার মাজা ধর্মের নামে ভাঙা।

এই রাজনৈতিক পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান স্মরণীয়।

স্নেহভাজন বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর একদম যথাস্থানে আঙ্গুল ঢুকিয়েছে এই দুটি বাংলা শব্দ মারফত : ‘ইতিহাসের দরজা’।

যার নামে হেন কাণ্ড ঘটতে পারে, অর্থাৎ ইতিহাসের দুয়ার খুলে যায়, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে একমাত্র তুলনা : বিশাল পর্বত। পাহাড় সব সময় মনে হয় নিকটে, কিন্তু তার অবস্থান দূরে। আবার অবস্থান দূরে হলেও নৈকট্য মুছে যায় না। মহান ব্যক্তিত্বের আলেখ্য এমনই। যারা তার নিকটে থাকে তারা কাছে থেকে হদিস পায় না সত্যিকার অবস্থানের।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘চরমপত্র’-খ্যাত তথ্য বিভাগের অফিসার হিসেবে এবং সাংবাদিকের মর্যাদা থেকে এমআর আখতার মুকুলের অসংখ্য সুবর্ণ সুযোগ ছিল বঙ্গবন্ধুর নৈকট্যের। নিশ্চয় এমন সান্নিধ্য ঈর্ষণীয় এবং লোভনীয়। এই ভাগ্যবান সাংবাদিক মুকুল এক পুস্তকে লিখেছে, তুষার কুজঝটিকার ভেতর দিয়ে সে হিমালয়কে দেখেছে। আমি যথা-উদ্ধৃতি দিতে পারলাম না। দুঃখিত। ভাবার্থ পরিবেশিত।

যাদের নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায়, বাস্তবিক তাদের সান্নিধ্য-নৈকট্যের বিচার সহজ হয় না। তারা কুজঝটিকার মধ্যে থাকেন অস্তিত্বের জানান-সহ।

বঙ্গবন্ধুকে আমি কাছ থেকে দেখেছি শারীরিকভাবে। কিন্তু সেই দেখা নিয়ে শুধু তাকে কাছের মানুষ বলতে পারব না। আবার যদি বলি-দূরের মানুষ, তাহলে তা হবে মিথ্যে ভাষণ।

পঞ্চাশ বছর না আরও তিন বছর পার হয়ে আমরা যদি পৌঁছাই অবিভক্ত বঙ্গদেশের রাজধানী কলকাতা শহরে... অর্থাৎ পরের দশকের গোড়ার দিকে-তাহলে দেখব পার্ক সার্কাসের একটি রেস্তোরাঁয় মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্টের কিছু নেতৃস্থানীয় তরুণ গুলতানি-মত্ত। কয়েকজনের নাম মনে আছে। বরিশাল-আগত নুরুদ্দিন আহমদ, সামান্য খঞ্জপদ আনোয়ার হোসেন, শ্রীহট্টবাসী মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, ফরিদপুর-আগত শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও কয়েকজন।

ওই দশক বড় হুল্লোড়ের দশক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংগ্রামরত ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস, আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি পরে আকাশতলায় বিচরণের লাইসেন্স-প্রাপ্ত অর্থাৎ বেআইনি থেকে আইনি পর্যায়ে আবির্ভূত। মুসলিম লীগের অন্যপিঠ হিন্দু মহাসভা আছে। এমন আবেষ্টনীর মধ্যে দৈনন্দিনতা। নানা হুল্লোড়ের হাউইয়ে রাজনৈতিক আকাশ দীপ্যমান।

ব্রিটিশ-খেদা স্বাধীনতা আন্দোলনেরই গতিপথে দেখা দিল হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলন। সুভাষ চন্দ্র বসুর আহ্বানে এই আন্দোলন শুরু হয়। সেই ডাক মুসলিম ছাত্রদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। শেখ মুজিবুর রহমান নামক এক ছাত্রও আন্দোলনের শরীক।

আমি পূর্বে বহুবার বলেছি, আজও বলছি, ইতিহাসের কি আশ্চর্য সমাপতন। উত্তরকালে একজনের নামের আগে যোগ হয়েছে ‘নেতাজী’ আর অন্যজনের ‘বঙ্গবন্ধু’। একজন ধর্মে হিন্দু, অপরজন মুসলমান... নিভাঁজ বাঙালিরূপে একে অপরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন কতো পূর্বে এবং শত শত বছরের মধ্যে এই দুই রাজনীতিবিদই কেবল বাঙালিদের উপহার দিয়ে গেছেন রাজনৈতিকভাবে আবেগের শিকড় যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Emotional Root. আর কেউ এমন চোখে পড়ে না। বিদ্যাপতি চন্ডীদাসের প্রাবাদিক মিলনের মতো দুই বাঙালির সাক্ষাৎ ঘটেছিল, অজানিতে যারা পরে ইতিহাসের নায়ক।

সংক্ষেপে নতুন প্রজন্মের ভাইবোনদের বলতে হয়, এক ছোট বদ্ধঘরে শতাধিক ইংরেজকে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল নবাবী আমলে। তারই স্মারকরূপে ব্রিটিশ শাসক তৈরি করেছিল ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’। পরে বাঙালি ঐতিহাসিকরা দেখলেন যে, ব্যাপারটা শাসনকর্তাদের বানোয়াট ব্যাপার। স্বাধীনতা আন্দোলনের এই পর্যায়ে বাঙালিরা সেই কলঙ্কমোচনে এগিয়ে আসে। সুভাষ চন্দ্র বসু খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ তখন। তিনিই প্রতিনিধিত্ব দেন দেশবাসীর পক্ষ থেকে এই কলঙ্ক মোচনার্থে।

সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ছাত্রমহলে বেশ পরিচিতি লাভ করে। পার্ক সার্কাসের রেস্তোরাঁয় মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্টের নেতারা জমায়েত হতো আড্ডা এবং চা-পানে। আদলে এবং নামে শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের চেনা ছিলেন। তার বেশি কিছু না। আরও কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি।

পরবর্তীকালে ভাঁজ কীভাবে উন্মোচিত হয় আপনারা জানেন। ভাষা আন্দোলনকালে আজকের বঙ্গবন্ধু আরও দেশবাসীর অন্তরে প্রবিষ্ট হলেন। তিনি যেন তারা খোলস ছাড়ছেন নতুন জন্মের তরে। মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্টের নেতা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবি-দাওয়া এক কথায় গন্তব্য-পথের দিশারীরূপে প্রতিনিধি তিনি। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নামেও পরিবর্তন সাধন করলেন। আওয়ামী লীগ হলো নিপাট আওয়ামী লীগ।

দ্বিজাতিতত্ত্বের অপর নাম সাম্প্রদায়িকতা বললে বোধ হয় কোন অত্যুক্তি করা হয় না। তার মূলে কুঠারাঘাত হানলেন একদা মুসলিম লীগপন্থি শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয়তাবাদের স্বরূপ তিনি শুধু হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। তাই জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি তেমন ভুল করেননি। আর অন্যপক্ষে বৈজ্ঞানিক পন্থায় রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের ঈমানেই ছিল দ্বৈধতা। এমনকি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র উচ্চারণে উচ্চারণে মুখ থেকে ফেনা তুলে কিছু নেতার ঠোঁট শুকিয়ে নীরস পাথরের তুলনা হয়ে গিয়েছিল, তাদের কথা আজ না বললেও চলে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ছিল না তা বলব না। তবে সামাজিক কলকব্জার ব্যাপারে তাদের আনাড়ী আহম্মক ছাড়া আর কী বলা চলে, ভেবে ওঠা দায়। লাঠির বাড়িতে মরা সাপের লেজ-আছড়ানি আপনারা দেখেছেন। তখন ওটা নড়ে ঠিক, কিন্তু সজীবতাও অবশিষ্ট। কিন্তু মূলের সঙ্গে তা যোগছিন্ন। বাংলাদেশের বামপন্থি আন্দোলনের এই ছবি অহরহ ভেসে আসে মর্মান্তিক দুঃখের সঙ্গে। কারণ, দেশের আত্মার সঙ্গে পরিচয় না থাকার ফলে, হাজার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এইসব নেতাকে বাতিল জাঙ্কারের স্তূপে ইতিহাসই নিক্ষেপ করেছে।

দেশের ইতিহাস-বয়ান নয়, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভূমিকার পটভূমি কী ছিল সেই ইঙ্গিত কিঞ্চিৎ দানই যথেষ্ট। ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার অবস্থান কোথায় ছিল সেই সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলার বাসনা এখানে। উদ্দেশ্য-পরিসর খুবই ছোট।

যার নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায় তার সান্নিধ্য বড় কথা নয়। স্পেসের ধারণা সেখানে অচলই বলা যায়।

শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি চাক্ষুষ দেখেছি সভায় বঙ্গভবনের কোনো জমায়েতে। তার সঙ্গে একটি বাক্যালাপও হয়নি কোনদিন। এখন বুঝতে পারি, পাতিবুর্জোয়া অহমিকায় আমি তার কাছে যাইনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও। যদিও এখন বুঝতে বিলম্ব হয় না, তখন আমার চিন্তায় যা ছিল, তা প্রকাশ করে আসা উচিত ছিল। ঐতিহাসিক একটি তরবারী আমরা পেয়েছিলাম, তার ব্যবহার শিখলাম না।

কোনোদিন আমি তার কাছে যাইনি। কারণ আমার তো কোনো কিছু প্রত্যাশা ছিল না তার কাছ থেকে। নিম্নমধ্যবিত্তের নৈতিকতাও এমন সংকীর্ণ হয়! আমার প্রত্যাশা ছিল না, কিন্তু দেশের জন্যে অনেক কিছু চাওয়ার ছিল যা রূপায়নে যে পাওয়ার প্রয়োজন তিনি তা তারই প্রতীক। এসব চিন্তা সেদিন আসেনি। বেজির মাথা। সেখানে কতটুকু বা মগজ থাকে? আজ বাঁশি হারিয়ে কোথায় ফুঁ দিচ্ছি? তা স্বীকার করতে আমার কোনো লজ্জা নেই।

বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে যাইনি। কিন্তু আমাদের যোগাযোগ ছিল।

আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারির পর কারারুদ্ধ তিনি ছয়ের দশকে। ঠিক তারিখ আজ মনে নেই। সেই সময় একটি গল্প লিখেছিলুম। নাম চিড়িমার। কোন পত্রিকায় বেরিয়ে ছিল আজ বলতে পারব না। তবে গল্পটা খুব সংক্ষেপে শোনাতে পারি।

ছুটি কাটাতে এক ভদ্রলোক এক ছোট পাহাড়ি পরিবেশে গিয়েছিলেন। সকালে বেড়াতে বেরিয়ে গাছপালার সেই রাজ্যে অনেক পাখির গান শুনতেন। রোজই শোনেন এবং খুব ভালো লাগে তার জায়গাটা। একদিন সকালে বেড়াতে বেরিয়ে দেখেন, পাখির গান বন্ধ। কোনো পাখিও বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের ভেতরে তার চোখে পড়ে চোয়াড় প্রকৃতির দুটো লোক। চুল উস্কখুষ্ক। পরে আছে হাফপ্যান্ট, খাকি হাফশার্ট। তাদের সামনে একটি ঝাঁকার ভেতর অনেক পাখি। কিন্তু সেগুলো গানের পাখি কোয়েল, দোয়েল ইত্যাদি। পরিচয়ে লোক দুটো বলল, তারা চিড়িমার। পাখি ধরে বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু ঝাঁকায় যে পাখি সেগুলো তো গান গায় এবং এ পাখি কেউ খায় না। সুতরাং এগুলো ধরেছ কেন? চিড়িমার দু’জন জবাবে বলল, গান গাইলে অন্য পাখি নড়েচড়ে। এক জায়গায় বসে না। তাই আগে গানের পাখি ধরেছি।

গল্পটি আমার ‘নেত্রপথ’ নামক বইয়ে আগে ১৯৬৮ সালে ছাপা। গল্পটি ১৯৬৩/৬৪ সালে কোন পত্রিকায় বেরিয়েছিল মনে নেই। সেই পত্রিকা পাচার হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছায়। গল্পটি শেখ সাহেব পড়ে বলেছিলেন, ‘বাইরে এমন লোক আছে এখনও? তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ আছে।’ সুতরাং কেউ বলতে পারবেন না, আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে যাইনি।

আর মনে রাখবেন আওয়ামী লীগের ছ-দফা ঘোষণার পাঁচ বছর পূর্বে ১৯৬১ সালে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ লেখা আমার ঘোষণা অনেক পূর্বে এবং তার একটি মাত্র দফা : এক দফা। যার তদানীন্তন প্রচ্ছন্ন জবাব : স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পর আর দুটি ঘটনা সংযোজন করতে চাই।

বঙ্গবন্ধুর আমলে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকার প্রকাশ রহিত করা হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী এই হামলার প্রতিবাদ আমরা করেছিলাম। বিবৃতিতে অবিশ্যি আমার স্বাক্ষর ছিল। বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেছিলেন, ‘শওকত সাহেবও আছেন দেখছি।’

এই ঘটনার পর বোধ হয় দু’মাস যায়নি, আওয়ামী লীগের কিছু বিশিষ্ট সদস্য পাঁচ-ছ’জন আমার বিরুদ্ধে নাশিল জানায়। বিশিষ্ট এই জন্যে যে, বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে প্রবেশের অধিকার ছিল তাদের।

তিনি ওদের বললেন, ‘শওকত সম্পর্কে তোমরা কী জানো? তারপর বিছানার তলা থেকে একটি বই বের করে বলেছিলেন ‘এটা পড়েছ?’

বইটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা প্রথম উপন্যাস। প্রসিদ্ধ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার পূজা-সংখায় এবং পুস্তক আকারে পরে প্রকাশিত : জাহান্নাম হইতে বিদায়।

আমার আনন্দ যে বইটি পড়েছেন বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় শত ব্যস্ততার মধ্যে।

ওই উপন্যাসে একটি ঘটনা আছে সংক্ষেপে বলছি : মিলিটারি-উপদ্রুত থেকে এক ভদ্রলোক নৌকাপথে শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন। মাঝি তাকে নৌকা চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করে, ‘শেখ মুজিব কি অ্যারেস্ট হইছেন?’ প্যাসেঞ্জার জবাব দেয় ‘হ্যাঁ’। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার মাঝি শুধায় ‘শেখ মুজিব কি অ্যারেস্ট হইছেন?’ ভদ্রলোক আবার জবাব দেন, ‘হ্যাঁ’। মাঝি চুপ থাকে কিছুক্ষণ। আরও স্তব্ধতার পর সে বলে যায়, ‘আপনে কিছুই জানেন না। হ্যারে কে অ্যারেস্ট কইরব?’

এই জবাবের পর লেখকের অর্থাৎ আমার মন্তব্য আছে : সাধনায় মানুষ ভাবমূর্তিতে পরিণত হয়। ভাবমূর্তি কেউ গ্রেফতার করতে পারে না।

বলা বাহুল্য, আমার বিরুদ্ধে মামলা তখনই ডিসমিস হয়ে যায়।

সভ্যতার মুখোশ পরিহিত স্বদেশী এবং আন্তর্জাতিক গুণ্ডা-ঘাতকদের আঘাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবার নিষ্প্রাণ ধরাশয়ী হওয়ার কয়েকদিন পর স্বেচ্ছায় আত্মনির্বাসনে গিয়েছিলাম। গণতান্ত্রিকতার সূচনা সম্ভাবনা যখন নস্যাৎ বরবাদ হয়ে গেল, তেমন শ্বাসরোধী আবহাওয়ায় লেখকের দিন-গুজরান প্রাণঘাতের পর্যায়ে পড়ে, অন্যান্য আত্মঘাতের কথা বাদ দিলেও। আমার নির্বাসন পূর্ব এবং মুজিবনগরের ডায়রি যথাক্রমে ‘উত্তরপূর্ব মুজিবনগর’ ও ‘স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর’ নামে প্রকাশিত। দুই বই মিলে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠা।

তীর্থযাত্রার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৈকট্যে পৌঁছানোর পথ এক  রকম তো নয়।

আজ পনেরই আগস্ট।

হিসাব-নিকাশের সঙ্গে নতুন শপথ গ্রহণের কথা এই দিনে, এই ভূখণ্ডের বাঙালি-সন্তান কেউ কি বিস্মৃত হতে পারে?

সান্নিধ্য সেখানে নিহিত।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের শত্রুরা নিপাত যাক।

জয় বঙ্গবন্ধু!

জয় বাংলা!

(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)