• শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

  • || ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

শরীয়তপুর বার্তা

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আয়োডিন

শরীয়তপুর বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ নভেম্বর ২০১৮  

মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য আয়োডিন একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা খুব সামান্য হলেও মানবদেহে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক বৃদ্ধি, মানসিক পরিপূর্ণতা, মস্তিষ্কের গঠন ও বিকাশের জন্য অয়োডিন অপরিহার্য। গর্ভবতী নারীদের অসময়ে গর্ভপাত রোধ এবং স্বাভাবিক প্রসবের জন্য আয়োডিনের অবদান অনস্বীকার্য। তাই গর্ভবতী মায়েদের তো বটেই, প্রতিটি মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আয়োডিনযুক্ত খাবার থাকা বাঞ্ছনীয়।
শিশুরা আয়োডিনের অভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এর মধ্যে অপূর্ণ মানসিক বিকাশ বা মানসিক প্রতিবন্ধিতা, কথা বলার অসুবিধা, তোতলামি, বোবা, কানে খাটো বা বধির হওয়া, বামন হওয়া, হাঁটার সমস্যা প্রভৃতি অন্যতম। এ ছাড়া আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ হয়ে থাকে, যা মানুষের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে নষ্ট করে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের গলার সামনের অংশে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থিগুলো ফুলে আকারে বড় হয়ে যায় এবং বাইরে থেকে তা সহজেই নজরে পড়ে। সাধারণত পুরুষের চেয়ে নারীরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। নারীদের এ রোগ হলে বিয়েতে সমস্যা হয়। মেয়েরা গলগণ্ড রোগে আক্রান্ত হলে পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয় এবং কখনও কখনও তা বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।
আমাদের দেশে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ একটি সামাজিক সমস্যা। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি লোকের কমবেশি গলগণ্ড রোগ রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় এক কোটি লোকের গলগণ্ড দৃশ্যমান। বাকি লোকদের গলগণ্ড রয়েছে, কিন্তু দেখা যায় না। আমাদের দেশে এখনও অনেক মানুষ আয়োডিন সমস্যায় ভুগছে। বাংলাদেশে প্রায় সব জেলাতেই কমবেশি গলগণ্ড রোগী রয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে গলগণ্ড রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
আয়োডিনের অভাবে শুধু যে মানুষের গলগণ্ড রোগ হয়, তা সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়। আয়োডিনের অভাবে যে কোনো বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে। তবে আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মা ও শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে আয়োডিনের অভাব অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মায়ের মৃত কিংবা বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসবের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া গর্ভবতী মায়ের দেহে আয়োডিনের অভাব হলে তার গর্ভের শিশুও গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়, কারণ মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য আয়োডিন অপরিহার্য। শিশুর মস্তিষ্কের গঠন দু’বছর বয়সের মধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। তাই গর্ভে থাকাকালে এবং জন্মের পর আয়োডিনের অভাব হলে শিশুর মস্তিষ্কের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে।
আয়োডিনস্বল্পতার কারণে শিশুরা বয়সের তুলনায় কম বুদ্ধিসম্পন্ন হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব শিশু আয়োডিনের ঘাটতিতে ভোগে তাদের মেধা ও বুদ্ধি স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় গড়ে দশ পয়েন্ট কম থাকে। আয়োডিনের ঘাটতিসম্পন্ন শিশুদের দেখতে স্বাভাবিক দেখালেও কম বুদ্ধিমত্তার কারণে তারা স্কুলে ভালো ফল করতে পারে না। শিশু ও গর্ভবতী মায়ের এসব গুরুতর সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে দেহের চাহিদা অনুযায়ী আয়োডিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা। আয়োডিনের চাহিদা বয়স অনুযায়ী হয়ে থাকে। শিশুর ক্ষেত্রে দৈনিক ৬০-১০০ মাইক্রোগ্রাম, একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের দৈনিক ১০০-১৪০ মাইক্রোগ্রাম, গর্ভবতী মহিলাদের ১২৫ মাইক্রোগ্রাম এবং স্তন্যদাত্রী মহিলাদের জন্য দৈনিক ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিনের প্রয়োজন হয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎস থেকে আয়োডিনের চাহিদা পূরণ করা যায়। পানি ও মাটি আয়োডিনের মূল উৎস। সমুদ্রের পানিতে সবচেয়ে বেশি আয়োডিন থাকে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ, কডলিভার তেল, শাকসবজি, খাবার পানি ও দুধেও আয়োডিন থাকে, কিন্তু আমাদের চাহিদা অনুযায়ী এ আয়োডিন একেবারেই নগণ্য। অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর মাটিতে আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকায় এসব এলাকার শাকসবজি, খাবার পানি এবং অন্যান্য খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ খুব কম মাত্রায় থাকে। বস্তুত বাংলাদেশের মাটি ও পানিতে অয়োডিনের ঘাটতি আছে, এ কারণে মাটি থেকে যে খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হয়, তাতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকে। এজন্য অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মতো খাদ্যের মাধ্যমে আয়োডিনের চাহিদা পূরণের সুযোগ কম। বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করে দেহে আয়োডিনের ঘাটতি পূরণ করা যায়। সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণ আয়োডিন থাকে। আমরা যদি সপ্তাহে অন্তত একদিন খাদ্যতালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারি, তবে আমাদের দেহে আয়োডিনের অভাব অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে।
আয়োডিনের ঘাটতি পূরণের উপায় হিসেবে সারা বিশ্বে আয়োডিনযুক্ত লবণের ব্যবহার স্বীকৃত ও বহুল প্রচলিত। এই লবণের জন্য খুব একটা বাড়তি খরচও লাগে না। সাধারণ লবণের মতোই এই লবণ ব্যবহার করা যায়। গর্ভবতী স্তন্যদাত্রী মাকে নিয়মিত আয়োডিনযুক্ত লবণ ও আয়োডিনসম্পন্ন খাবারদাবার গ্রহণ করতে হবে। এতে গর্ভবতী মায়ের শরীরের আয়োডিনের অভাব দূর হবে, গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক গঠনও বৃদ্ধি পাবে। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত আয়োডিন গ্রহণের ফলে গলগণ্ড বা ঘ্যাগ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাই পরিবারের রান্নাবান্না ও অন্যান্য খাবারে সব সময় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করা উচিত।
সর্বোপরি আয়োডিনের অভাবজনিত রোগবালাই থেকে মুক্ত হয়ে সুস্থ ও সবল জাতি গড়ে তুলতে গর্ভবতী মা ও শিশুসহ পরিবারের সবাইকেই সাধারণ লবণের পরিবর্তে নিয়মিত আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণের জন্য ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।